আকীদা বিশুদ্ধ করবার পর শরীয়তের পাবন্দ হবার চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া প্রয়োজন। কারন, শরীয়ত প্রতিপালনের উপরেই দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা সম্পূর্ণ নির্ভর করে। শরীয়তের তিনটি উপাদান--
এলেম, আমল ও এখলাছ।
এই তিনটি উপাদান পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। এদের যেকোনো একটি বর্জন করলে অপর দুটি মূল্যহীন হয়ে যায়। সুতরাং তিনটি উপাদানই সমান গুরুত্ব সহকারে অর্জন করবার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এবার এক এক করে আমরা এই উপাদানসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করব।
এলেমঃ জ্ঞানই আলো। অজ্ঞতা অন্ধকার। ইসলামের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে মিথ্যার অন্ধকার থেকে সত্যের আলোর দিকে পথপ্রদর্শন করা। তাই ইসলামে এলেম শিক্ষাকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। এই এলেম দ্বীনের এলেম—শরীয়তের এলেম।
মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে এলেম শিক্ষা করা ফরজ’(ইবনে মাজাহ্)।
প্রত্যেক মুসলমানকে তাই আল্লাহপাকের হুকুমসমূহ সম্পর্কে এবং নিষেদাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। হালাল, হারাম, ফরজ, অয়াজেব এবং অন্যান্য প্রসঙ্গিক বিষয়ে এলেম শিক্ষা করা জরুরী। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এলেম দুই প্রকার। জবানী এলেম এবং কলবী এলেম (মেশকাত)।
মহানবী (সঃ) এলেম শিক্ষা করাকে ফরজ বলেছেন। শুধুমাত্র জবানী এলেম শিক্ষা করাকে অথবা শুমাত্র কলবী এলেম শিক্ষা করাকে তিনি ফরজ বলেননি। আর এলেম যেহেতু দুই রকম তাই দুই রকম এলেম শিক্ষা করাই ফরজ। তবে এই ফরজের সীমারেখা কতদূর সে সম্পর্কেও আমাদের স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হবে।
আমরা জানি পাঁচটি স্তম্ভের উপরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত। এই পাঁচ স্তম্ভ নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করতে হলে অবশ্যই এই সকল বিষয় কিভাবে সম্পন্ন করতে হবে, তাঁর এলেম অর্জন করাও আমাদের প্রতি জরুরী হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী নন, তাঁদের জন্য হজ্ব, জাকাত ফরজ নয়। সুতরাং এসব বিষয়ে এলেম শিক্ষা করাও তাঁদের প্রতি ফরজ নয়। মোট কথা, শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের যার উপরে যতখানি আমল জরুরী হয়ে পড়ে, সে সকল আমল সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এলেম শিক্ষা করাও ফরজ হয়ে যায়।
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হাফেজে কোরআন হওয়া, মুহাদ্দিস, মুফাসসির হওয়া ফরজ নয়। তেমনি কলবী এলেমের ক্ষেত্রেও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কুতুব, গাউস, আবদাল, আওতাদ, মোজাদ্দেদ হওয়া ফরজ নয়।
যতটুকু এলেম শিখলে একজন মুসলমানের কলব (অন্তর) গায়রুল্লাহর মহব্বত থেকে মুক্ত হয় এবং সালিম (প্রশান্ত) অবস্থা ধারণ করে, ততটুকু কলবী এলেম শিক্ষা করা ফরজ। কারন আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিনে তোমাদের ধন-সম্পদ সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, কাজে আসবে শুধু সালিম কলব’(সূরা শুআরা) ।
আর কলবের প্রশান্ত অবস্থা তখনই হাসিল হয়, যখন কলবে জিকিরের নূর প্রজ্বলিত হয়। শান্তি আল্লাহর জিকিরের মধ্যেই নিহিত। অন্য কিছুতেই নয়। যেমন, আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর জিকির দ্বারাই কলব শান্তি লাভ করে’(সূরা রাআদ)।
জবানী এলেম শিক্ষা করতে গেলে মাদ্রাসায় দাখেল হতে হয়। অথবা ফেকাহ্র কেতাব পাঠ করতে হয়। অক্ষরজ্ঞান না থাকলে আলেমগণের কাছ থেকে জেনে নিতে হয়।
আর কলবী এলেম শিখতে গেলে এমন ব্যক্তির শরনাম্পন্ন হতে হয়, যার কলবে জিকিরের নূর প্রজ্বলিত থাকে সারাক্ষণ। এইরূপ ব্যক্তির সহবত এখতেয়ারের জন্য তাঁর নিকট মুরিদ বা বায়াত হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বায়াতের প্রেমময় বন্ধনের সূত্র ধরেই এইরূপ বুজুর্গ ব্যক্তির কলব থেকে জিকিরের নূর মুরিদের কলবে প্রতিবিম্বিত হয়ে মুরিদের কলবও জিকিরময় হয়ে ওঠে। আর তখনই কলব সালিম অবস্থায় পৌঁছতে পারে। যিনি কলবী এলেম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তাকেই পীর বা মোর্শেদ বলা হয়। জাহেরী এলেম শিক্ষার শেষে অথবা সাথে সাথে কলবী এলেমের শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া উচিত। নতুবা ফরজ তরক করার দায়ে দায়ী হতে হবে।
আমলঃ এলেম শিক্ষার সাথে সাথে আমলও করা চাই। কারন এলেম অর্জনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমল করা। সুতরাং আমল না হলে এলেম শিক্ষার কোনই অর্থ হয় না।
আমরা আল্লাহতায়ালার বান্দা। বন্দেগীর হক আদায় করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর বন্দেগীর নিয়ম কানুন শিক্ষার জন্যেই আমাদেরকে এলেম অর্জন করতে হয়। তাই এলেম অনুযায়ী আমল করতেই হবে।
এখলাছঃ এখলাছ অর্থ বিশুদ্ধ নিয়ত অর্জন করা। নিয়ত অর্থ সঙ্কল্প—ইচ্ছা। সঙ্কল্পও শুদ্ধ হওয়া চাই। কারন, একমাত্র আল্লাহপাকের হুকুম প্রতিপালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য যেকোন উদ্দেশ্যে যতপ্রকার এবং যতবেশী এলেম শিক্ষা করা হোক অথবা যতবেশী আমল করা হোক না কেনো—তাতে কোনই লাভ হবে না। তাই এখলাছও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন কীভাবে বিশুদ্ধ নিয়ত অর্জন করতে হয়, সে সম্পর্কে আমরা কিঞ্চিত আলোচনা করব। নিয়তের উৎপত্তিস্থল কলব বা অন্তর। মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ফরজ নয়। অন্তরে সঙ্কল্প স্থির করা ফরজ। যেকোন এবাদত সম্পাদন করার পূর্বে নিয়ত করা জরুরী। হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে—নিয়ত অনুযায়ী আমল বিচার করা হবে (বোখারী)।
কলব বা অন্তঃকরণ সৎ-অসৎ সকল প্রকার কার্যকলাপের পরিকল্পনাস্থল। শয়তান এই স্থানেরই বাসা বাঁধে। মানুষের শত্রু এই শয়তানই মানুষকে অসৎ কর্মের প্রতি প্ররোচিত করে। শয়তান যতক্ষণ কলবকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কলব থেকে বিশুদ্ধ নিয়ত হওয়া সম্ভব নয়। কারন কলবে তাঁর অবস্থানের কারনে কলবও অশুদ্ধ হয়ে যায়। তাই অশুদ্ধ কলবের নিয়ত অশুদ্ধ হতে বাধ্য।
অতএব, কলব বিশুদ্ধ করতে হলে অবশ্যই শয়তানকে সেখান থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে এখলাছ বা বিশুদ্ধ নিয়ত করা। হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, “শয়তান মানুষের কলবের মধ্যে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। যদি কলব জিকির করে তবে শয়তান সেখান থেকে পালিয়ে যায়, আর যদি কলব জিকির থেকে গাফেল থাকে তবে শয়তান আবার সেখানে বসে কমন্ত্রনা দিতে থাকে”। (বোখারী)
শয়তান তাঁর মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আমাদের নামাজের সময়। কারন সে জানে, যদি আমাদের নামাজ বিশুদ্ধ হয়, তবে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রদত্ত যে শক্তি আমরা লাভ করব—সেই শক্তির মোকাবেলা করার ক্ষমতা তাঁর নেই। সকল এবাদতের সারাংশ ‘নামাজ’ বিশুদ্ধ হলেই কেবল আমরা আল্লাহ্পাকের যাবতীয় অপছন্দনীয় কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হতে পারব।
আল্লাহ্পাকের এরশাদ—“নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে যাবতীয় অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে”। (সূরা আনকাবুত)
নামাজ তখনই বিশুদ্ধ হয় যখন নামাজী তাঁর শরীর, পোশাক, মন পবিত্র করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে নামাজের রোকনসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে পারে।
আল্লাহপাক পবিত্র। পবিত্র ব্যক্তিগণ ব্যতীত অন্য কেউই তাঁর এবাদতে সফল হতে পারে না। শুধু বাহির নয় অন্তরও পবিত্র করতে হবে। অজু বা গোসল দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা হাসেল হয়। আর অন্তরের পবিত্রতা হাসিল হয় আল্লাহপাকের জিকির দ্বারা।
কলবে আল্লাহপাকের জিকির জারী থাকা প্রয়োজন এবং এইরূপ জিকির সকল সময়ই জারী থাকা প্রয়োজন। যখনই কলব জিকির থেকে গাফেল থাকবে তখনই কলবের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার চলে যাবে শয়তানের হাতে। সে তখন সর্বপ্রকার নেক আমলের উৎস নিয়তকে করবে কলুষিত এবং সকল অসৎ কার্যাবলী থেকে মুক্তির চাবিকাঠি নামাজের একাগ্রতা নষ্ট করে দিয়ে নামাজকে করবে বরবাদ। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “একাগ্রতা ছাড়া নামাজ হয় না”।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন, “সালাত কায়েম কর আমার স্মরণের জন্য”। (সূরা ত্বাহা)
এই বিপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার পেতেই হবে। তাই কলবে বিরতিহীনভাবে জিকির জারী করবার জন্য আমাদেরকে কলবী এলেমের ওস্তাদ বা পীরের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রকৃত পীর এই এলেমেরই বিশেষজ্ঞ।
এবার বুঝা গেলো সূফীগণের মধ্যে প্রচলিত যেকোন তরিকায় দাখেল হওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এখলাছ অর্জন করা। অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়। যেমন অনেকেই নানান রকম বিকৃত ইচ্ছা নিয়ে বিভিন্ন পীরের দরবারে ভিড় জমান এবং কোন কোন পীর নামধারী ব্যক্তিও মানুষের মূল উদ্দেশ্যবিবর্জিত ঐ সকল কলুষ ধারনাকে লালন করে থাকেন।
আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় জানলাম যে, এলেম, আমল, এখলাছ—তিনটিই জরুরী। এদের যেকোন একটি বর্জন করলে অপর দুটিও মূল্যহীন হয়ে যায়। যেমন কোন ব্যক্তির যদি এলেম না থাকে, শুধু আমল, এখলাছ থাকে তবে তাঁর কোনই মূল্য হতে পারে না। আবার যদি এলেম ও এখলাছ থাকে—আমল না থাকে—তখনও একই অবস্থা। আবার এলেম, আমল থাকলেও তা এখলাছের অভাবে নিরর্থক।
সুতরাং বুঝা গেল্, শরীয়তের পূর্ন পাবন্দ হতে গেলে সূফী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত যেকোন তরিকায় দাখেল হওয়া উচিত। কারন তরিকায় দাখেল না হলে প্রকৃত এখলাছ হওয়া সম্ভব নয়। এই বিবেচনায় তরিকত হল জাহেরী শরীয়তের খাদেম বা সহায়ক।
এখন প্রশ্নঃ কোন্ তরিকা গ্রহণ করতে হবে ? প্রকৃতপক্ষে সব তরিকার উদ্দেশ্য একই। তবে এই জামানার জন্য সবচেয়ে উপযোগী তরিকা হচ্ছে ‘খাস মোজাদ্দেদিয়া তরিকা’।
কারন অন্যান্য তরিকার মত কঠোর মোজাহেদা এই তরিকায় উন্নতির শর্ত নয়। আল্লাহ্পাক যেমন আজিমত (কষ্টসাধ্য) আমল পছন্দ করেন, তেমনি রুখসত (সহজসাধ্য) আমলও পছন্দ করেন। জীবন এখন জটিল। সময় সংকীর্ন। তাই সহজ তরিকাই সকলের গ্রহণ করা দরকার। এই তরিকায় মুরিদ অতি সহজেই তাঁর পীরের রূহানী তাওয়াজ্জোহ্ এর বদৌলতে নিজের ক্বলব জিন্দা করে নিতে পারেন। এর নিম্ন সময়সীমা মুরিদ হবার সঙ্গে সঙ্গে। ঊর্ধ সময়সীমা চল্লিশ দিন। এর পরের স্তরসমূহও অতিক্রম করা যায় অতি দ্রুত এবং অত্যন্ত সহজে।
একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, তরিকা পৌঁছায় না। পৌঁছায় পীর। অর্থাৎ যত শানদার তরিকাই হোক, সেই তরিকার পূর্ন কামালিয়াতসম্পন্ন পীরই কেবল মুরিদগণকে মকসুদ মঞ্জিলে পৌঁছানোর ব্যাপারে রূহানী সহযোগীতা প্রদান করতে পারেন। পীরের কামালিয়াত না থাকলে শুধুমাত্র তরিকার নামে বায়াত হলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।
আমরা মুসলমান। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে রসূল (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র বাণী, কুল্লু মুসলিমুন ইখ্ওয়াতুন। সকল মুসলমান ভাই ভাই। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ্র কালাম, উম্মাতুন ওয়াহিদাতুন—তোমরা তো একই জাতি। আজ মুসলমানদের দুর্দিন। সকল পৃথিবী জুড়ে আমরাই আজ সবার চাইতে বেশী অবহেলিত, লাঞ্ছিত। আমাদের নবী মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্ (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) যেমন নবীগণের ইমাম তেমনি আমাদেরও হবার কথা পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়ের ইমাম বা নেতা। কিন্তু বাস্তব আমাদেরকে কি দৃশ্য দেখাচ্ছে ? কি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেক, কি মুসলমান সংখ্যালঘু দেশ—সবস্থানেই আমরা লাঞ্ছিত, অপদস্থ। কোথাও সম্পদের প্রাচুর্যের কারনে আমরা প্রবৃত্তির পীড়নের শিকার। আবার কোথাও দারিদ্র, অশিক্ষা ও সংখ্যালঘুতার কারনে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা নিগৃহীত।
এ অবস্থা থেকে আমাদের আশু উত্তরণ প্রয়োজন। হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজন আত্নসমালোচনায় নিমগ্ন হয়ে নিজেরদের দোষত্রুটি থেকে মুক্তের সাধনা। আমরা যারা যে স্তরেরই লোক হই না কেন—কৃষক শ্রমিক থেকে রাষ্ট্রের কর্নধার, সবারই মূল পরিচয়, আমরা আল্লাহ্ পাকের বান্দা—রসুলেপাক (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর উম্মত। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের উপরে দায়িত্ব দেশে ইসলামী আইন কানুন প্রবর্তন করা। যাতে করে মানুষের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহপাকের আইনই আইন। হে রাষ্ট্রপ্রধানগণ! কোন্ সাহসে আপনারা আল্লাহ্র জমিনে আল্লাহর দ্বীন-বিরোধী আইন জিইয়ে রেখেছেন ? মনে রাখবেন, আখেরাতে আল্লাহ্র সম্মুখে আপনাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
আলেমগনের উপরে দায়িত্ব—দ্বীনের শিক্ষায় সকল শ্রেণীর মুসলমানকে উজ্জীবিত করা। কোরআন হাদিসের ভিত্তিতে সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার ফয়সালা করা, শরীয়তের শান শওকত বুলন্দ করা। আপনারা নিজেদেরকে নায়েবে রসূল বলে মনে করেন। কিন্তু কোথায় সেই কোরবানি, ত্যাগ? হে আলেম সম্প্রদায় ভেবে দেখুন, আপনারা কি নায়েবে রসূলের দায়িত্ব পালনে তৎপর রয়েছেন ? সম্মান, কর্তৃত্ব, অর্থ, খ্যাতি লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকে আপনারা কি বিস্মৃত হননি মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর বাণী, ‘আখেরাতে ঐ আলেমের সবচেয়ে বেশী শাস্তি হবে—যে তাঁর এলেম দ্বারা উপকৃত হয়নি’।
সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব—মানুষের অন্তর্জগতে আল্লাহ্প্রেমের নূরপ্রবাহ জারী করবার মহান কাজে আঞ্জাম দেয়া। কিন্তু কি হচ্ছে বাস্তবে ? হে সূফী সম্প্রদায়! অর্থ উপার্জন, নজরানা, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, গান-বাজনা, প্রতিপত্তিশালী মানুষের মোসাহেবী—এসবই হয়ে উঠেছে আপনাদের মূল উদ্দেশ্য। দ্বীনের খাদেম বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে দ্বীনের দুশমনির কাজে আপনারা লিপ্ত হয়েছেন কেন ?
দ্বীনের দুশমন তিনটি দল। দুনিয়াদার বাদশাহ্, দুনিয়াদার আলেম (ওলামায়) এবং ভণ্ড সূফী। এই তিন দলের এছলাহ্ (সংশোধন) না হলে দ্বীনের শান বিকশিত হতে পারে না। দ্বীনদার রাষ্ট্রনায়ক, দ্বীনদার আলেম এবং কামেল সূফীই দ্বীনকে সমুন্নত করবার মহান কাজের আঞ্জাম দিতে পারেন।
সাধারণ মুসলমানকে দ্বীন বিকৃত করবার দায়ে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নন। তবুও তাঁরা সম্পূর্নভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। দ্বীনের জ্জানার্জন করবার জন্য দ্বীনদার আলেম এবং কামেল পীরের শরণাপন্ন হওয়া তাঁদের জন্যও জরুরী। কিন্তু তাঁরা আলেম ও পীরের শরণাপন্ন হন দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে। আর তাঁদের প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবসা বিস্তার করে বসেছে আলেম ও পীর সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ।
আর এক দিকে বয়ে যাচ্ছে ইসলামবিরোধী মতবাদের সয়লাব। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ অনৈসলামিক মতবাদের অন্ধকারে ক্রমশঃ নিমজ্জমান। তারাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাঁরা ইসলাম বিরোধী মতবাদের বিরাটাকায় গ্রন্থ অধ্যয়নে, অনুশীলনে ও গবেষণায় সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকেন, কিন্তু কোরআন হাদিসের শিক্ষার প্রতি এতটুকু দৃষ্টিপাত করবার সময় তাঁদের নেই। তাঁরা কি জানেন না—দ্বীনের জ্ঞানার্জন, শরীয়তের হুকুম শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শ্রমিক, কৃষক, শিল্পপতি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবী সকলের উপর ফরজ।
আমাদের রাষ্ট্রনায়কগণ, আমাদের আলেম সমাজ, আমাদের মাশায়েখবৃন্দ, আমাদের সমাজ সচেতন শিক্ষিত সম্প্রদায়—আমরা সবাই মুসলমান জামাতের অন্তর্ভুক্ত, আমাদের কারো পদস্খলনে আমরা কেউই উদাসীন থাকতে পারি না। আমরা সবাই তো একক জাতি।। উম্মাহাতুল ওয়াহিদুন। আমরা জানি আমাদের কোন অঙ্গ দূর্বলতার শিকার হলে তাতে আমাদেরই ক্ষতি, তাতে আমাদেরই শক্তি খর্ব হয়। তাই আমরা আমাদের সম্মিলিত আত্মসমালোচনার অংশ হিসেবে প্রত্যেকেই নিজেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভাল করে বিবেচনা করে দেখিঃ
১) আমাদের আকীদা ঠিক কিনা ?
২) আমাদের দ্বীনের এলেমের দুইটি ধারাকেই (জবানী এলেম ও কলবী এলেম) সমান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি কিনা ?
৩) এলেম অনুযায়ী আমল করছি কিনা ?
৪) এখলাছ অর্জনের জন্য যুগোপযোগী তরিকায় দাখেল হয়েছি কিনা ?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলির বাস্তব জবাব দ্বারা আমাদের প্রত্র্যকের ব্যক্তিগত জীবন সজ্জিত করতে হবে পারিবারিক জীবনে, সমাজ জীবনে এবং আন্তর্জাতিক জীবনে। তবেই আমাদের সমষ্টিগত জীবনে কায়েম হবে পূর্ন দ্বীন। তবেই তবলীগ, একামাতে দ্বীন, জেহাদের হক আদায় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
যে ব্যক্তি তাঁর নিজের অস্তিত্বে রাজত্বে পূর্ন দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম নয়, সে কি কখনো রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামাজিক জীবনে দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম হতে পারে ? কখনই নয়।
অতএব, হে মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ! আসুন হুশিয়ার হই। সমাজে দেশে ও বিশ্বে পূর্ন দ্বীন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সামনে রেখে প্রথমেই নিজেদেরকে পূর্ন দ্বীনের সাজে সজ্জিত করবার সাধনায় নিয়োজিত হই আমরা।
ওয়াস্সালামো আউয়ালাঁও ওয়া আখেরান।
এলেম, আমল ও এখলাছ।
এই তিনটি উপাদান পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। এদের যেকোনো একটি বর্জন করলে অপর দুটি মূল্যহীন হয়ে যায়। সুতরাং তিনটি উপাদানই সমান গুরুত্ব সহকারে অর্জন করবার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এবার এক এক করে আমরা এই উপাদানসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করব।
এলেমঃ জ্ঞানই আলো। অজ্ঞতা অন্ধকার। ইসলামের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে মিথ্যার অন্ধকার থেকে সত্যের আলোর দিকে পথপ্রদর্শন করা। তাই ইসলামে এলেম শিক্ষাকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। এই এলেম দ্বীনের এলেম—শরীয়তের এলেম।
মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে এলেম শিক্ষা করা ফরজ’(ইবনে মাজাহ্)।
প্রত্যেক মুসলমানকে তাই আল্লাহপাকের হুকুমসমূহ সম্পর্কে এবং নিষেদাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। হালাল, হারাম, ফরজ, অয়াজেব এবং অন্যান্য প্রসঙ্গিক বিষয়ে এলেম শিক্ষা করা জরুরী। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এলেম দুই প্রকার। জবানী এলেম এবং কলবী এলেম (মেশকাত)।
মহানবী (সঃ) এলেম শিক্ষা করাকে ফরজ বলেছেন। শুধুমাত্র জবানী এলেম শিক্ষা করাকে অথবা শুমাত্র কলবী এলেম শিক্ষা করাকে তিনি ফরজ বলেননি। আর এলেম যেহেতু দুই রকম তাই দুই রকম এলেম শিক্ষা করাই ফরজ। তবে এই ফরজের সীমারেখা কতদূর সে সম্পর্কেও আমাদের স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হবে।
আমরা জানি পাঁচটি স্তম্ভের উপরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত। এই পাঁচ স্তম্ভ নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করতে হলে অবশ্যই এই সকল বিষয় কিভাবে সম্পন্ন করতে হবে, তাঁর এলেম অর্জন করাও আমাদের প্রতি জরুরী হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী নন, তাঁদের জন্য হজ্ব, জাকাত ফরজ নয়। সুতরাং এসব বিষয়ে এলেম শিক্ষা করাও তাঁদের প্রতি ফরজ নয়। মোট কথা, শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের যার উপরে যতখানি আমল জরুরী হয়ে পড়ে, সে সকল আমল সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এলেম শিক্ষা করাও ফরজ হয়ে যায়।
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হাফেজে কোরআন হওয়া, মুহাদ্দিস, মুফাসসির হওয়া ফরজ নয়। তেমনি কলবী এলেমের ক্ষেত্রেও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কুতুব, গাউস, আবদাল, আওতাদ, মোজাদ্দেদ হওয়া ফরজ নয়।
যতটুকু এলেম শিখলে একজন মুসলমানের কলব (অন্তর) গায়রুল্লাহর মহব্বত থেকে মুক্ত হয় এবং সালিম (প্রশান্ত) অবস্থা ধারণ করে, ততটুকু কলবী এলেম শিক্ষা করা ফরজ। কারন আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিনে তোমাদের ধন-সম্পদ সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, কাজে আসবে শুধু সালিম কলব’(সূরা শুআরা) ।
আর কলবের প্রশান্ত অবস্থা তখনই হাসিল হয়, যখন কলবে জিকিরের নূর প্রজ্বলিত হয়। শান্তি আল্লাহর জিকিরের মধ্যেই নিহিত। অন্য কিছুতেই নয়। যেমন, আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর জিকির দ্বারাই কলব শান্তি লাভ করে’(সূরা রাআদ)।
জবানী এলেম শিক্ষা করতে গেলে মাদ্রাসায় দাখেল হতে হয়। অথবা ফেকাহ্র কেতাব পাঠ করতে হয়। অক্ষরজ্ঞান না থাকলে আলেমগণের কাছ থেকে জেনে নিতে হয়।
আর কলবী এলেম শিখতে গেলে এমন ব্যক্তির শরনাম্পন্ন হতে হয়, যার কলবে জিকিরের নূর প্রজ্বলিত থাকে সারাক্ষণ। এইরূপ ব্যক্তির সহবত এখতেয়ারের জন্য তাঁর নিকট মুরিদ বা বায়াত হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বায়াতের প্রেমময় বন্ধনের সূত্র ধরেই এইরূপ বুজুর্গ ব্যক্তির কলব থেকে জিকিরের নূর মুরিদের কলবে প্রতিবিম্বিত হয়ে মুরিদের কলবও জিকিরময় হয়ে ওঠে। আর তখনই কলব সালিম অবস্থায় পৌঁছতে পারে। যিনি কলবী এলেম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তাকেই পীর বা মোর্শেদ বলা হয়। জাহেরী এলেম শিক্ষার শেষে অথবা সাথে সাথে কলবী এলেমের শিক্ষায় মনোযোগী হওয়া উচিত। নতুবা ফরজ তরক করার দায়ে দায়ী হতে হবে।
আমলঃ এলেম শিক্ষার সাথে সাথে আমলও করা চাই। কারন এলেম অর্জনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমল করা। সুতরাং আমল না হলে এলেম শিক্ষার কোনই অর্থ হয় না।
আমরা আল্লাহতায়ালার বান্দা। বন্দেগীর হক আদায় করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আর বন্দেগীর নিয়ম কানুন শিক্ষার জন্যেই আমাদেরকে এলেম অর্জন করতে হয়। তাই এলেম অনুযায়ী আমল করতেই হবে।
এখলাছঃ এখলাছ অর্থ বিশুদ্ধ নিয়ত অর্জন করা। নিয়ত অর্থ সঙ্কল্প—ইচ্ছা। সঙ্কল্পও শুদ্ধ হওয়া চাই। কারন, একমাত্র আল্লাহপাকের হুকুম প্রতিপালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য যেকোন উদ্দেশ্যে যতপ্রকার এবং যতবেশী এলেম শিক্ষা করা হোক অথবা যতবেশী আমল করা হোক না কেনো—তাতে কোনই লাভ হবে না। তাই এখলাছও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন কীভাবে বিশুদ্ধ নিয়ত অর্জন করতে হয়, সে সম্পর্কে আমরা কিঞ্চিত আলোচনা করব। নিয়তের উৎপত্তিস্থল কলব বা অন্তর। মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ফরজ নয়। অন্তরে সঙ্কল্প স্থির করা ফরজ। যেকোন এবাদত সম্পাদন করার পূর্বে নিয়ত করা জরুরী। হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে—নিয়ত অনুযায়ী আমল বিচার করা হবে (বোখারী)।
কলব বা অন্তঃকরণ সৎ-অসৎ সকল প্রকার কার্যকলাপের পরিকল্পনাস্থল। শয়তান এই স্থানেরই বাসা বাঁধে। মানুষের শত্রু এই শয়তানই মানুষকে অসৎ কর্মের প্রতি প্ররোচিত করে। শয়তান যতক্ষণ কলবকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কলব থেকে বিশুদ্ধ নিয়ত হওয়া সম্ভব নয়। কারন কলবে তাঁর অবস্থানের কারনে কলবও অশুদ্ধ হয়ে যায়। তাই অশুদ্ধ কলবের নিয়ত অশুদ্ধ হতে বাধ্য।
অতএব, কলব বিশুদ্ধ করতে হলে অবশ্যই শয়তানকে সেখান থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে এখলাছ বা বিশুদ্ধ নিয়ত করা। হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, “শয়তান মানুষের কলবের মধ্যে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। যদি কলব জিকির করে তবে শয়তান সেখান থেকে পালিয়ে যায়, আর যদি কলব জিকির থেকে গাফেল থাকে তবে শয়তান আবার সেখানে বসে কমন্ত্রনা দিতে থাকে”। (বোখারী)
শয়তান তাঁর মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আমাদের নামাজের সময়। কারন সে জানে, যদি আমাদের নামাজ বিশুদ্ধ হয়, তবে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রদত্ত যে শক্তি আমরা লাভ করব—সেই শক্তির মোকাবেলা করার ক্ষমতা তাঁর নেই। সকল এবাদতের সারাংশ ‘নামাজ’ বিশুদ্ধ হলেই কেবল আমরা আল্লাহ্পাকের যাবতীয় অপছন্দনীয় কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হতে পারব।
আল্লাহ্পাকের এরশাদ—“নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে যাবতীয় অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে”। (সূরা আনকাবুত)
নামাজ তখনই বিশুদ্ধ হয় যখন নামাজী তাঁর শরীর, পোশাক, মন পবিত্র করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে নামাজের রোকনসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে পারে।
আল্লাহপাক পবিত্র। পবিত্র ব্যক্তিগণ ব্যতীত অন্য কেউই তাঁর এবাদতে সফল হতে পারে না। শুধু বাহির নয় অন্তরও পবিত্র করতে হবে। অজু বা গোসল দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা হাসেল হয়। আর অন্তরের পবিত্রতা হাসিল হয় আল্লাহপাকের জিকির দ্বারা।
কলবে আল্লাহপাকের জিকির জারী থাকা প্রয়োজন এবং এইরূপ জিকির সকল সময়ই জারী থাকা প্রয়োজন। যখনই কলব জিকির থেকে গাফেল থাকবে তখনই কলবের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার চলে যাবে শয়তানের হাতে। সে তখন সর্বপ্রকার নেক আমলের উৎস নিয়তকে করবে কলুষিত এবং সকল অসৎ কার্যাবলী থেকে মুক্তির চাবিকাঠি নামাজের একাগ্রতা নষ্ট করে দিয়ে নামাজকে করবে বরবাদ। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “একাগ্রতা ছাড়া নামাজ হয় না”।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন, “সালাত কায়েম কর আমার স্মরণের জন্য”। (সূরা ত্বাহা)
এই বিপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার পেতেই হবে। তাই কলবে বিরতিহীনভাবে জিকির জারী করবার জন্য আমাদেরকে কলবী এলেমের ওস্তাদ বা পীরের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রকৃত পীর এই এলেমেরই বিশেষজ্ঞ।
এবার বুঝা গেলো সূফীগণের মধ্যে প্রচলিত যেকোন তরিকায় দাখেল হওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এখলাছ অর্জন করা। অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়। যেমন অনেকেই নানান রকম বিকৃত ইচ্ছা নিয়ে বিভিন্ন পীরের দরবারে ভিড় জমান এবং কোন কোন পীর নামধারী ব্যক্তিও মানুষের মূল উদ্দেশ্যবিবর্জিত ঐ সকল কলুষ ধারনাকে লালন করে থাকেন।
আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় জানলাম যে, এলেম, আমল, এখলাছ—তিনটিই জরুরী। এদের যেকোন একটি বর্জন করলে অপর দুটিও মূল্যহীন হয়ে যায়। যেমন কোন ব্যক্তির যদি এলেম না থাকে, শুধু আমল, এখলাছ থাকে তবে তাঁর কোনই মূল্য হতে পারে না। আবার যদি এলেম ও এখলাছ থাকে—আমল না থাকে—তখনও একই অবস্থা। আবার এলেম, আমল থাকলেও তা এখলাছের অভাবে নিরর্থক।
সুতরাং বুঝা গেল্, শরীয়তের পূর্ন পাবন্দ হতে গেলে সূফী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত যেকোন তরিকায় দাখেল হওয়া উচিত। কারন তরিকায় দাখেল না হলে প্রকৃত এখলাছ হওয়া সম্ভব নয়। এই বিবেচনায় তরিকত হল জাহেরী শরীয়তের খাদেম বা সহায়ক।
এখন প্রশ্নঃ কোন্ তরিকা গ্রহণ করতে হবে ? প্রকৃতপক্ষে সব তরিকার উদ্দেশ্য একই। তবে এই জামানার জন্য সবচেয়ে উপযোগী তরিকা হচ্ছে ‘খাস মোজাদ্দেদিয়া তরিকা’।
কারন অন্যান্য তরিকার মত কঠোর মোজাহেদা এই তরিকায় উন্নতির শর্ত নয়। আল্লাহ্পাক যেমন আজিমত (কষ্টসাধ্য) আমল পছন্দ করেন, তেমনি রুখসত (সহজসাধ্য) আমলও পছন্দ করেন। জীবন এখন জটিল। সময় সংকীর্ন। তাই সহজ তরিকাই সকলের গ্রহণ করা দরকার। এই তরিকায় মুরিদ অতি সহজেই তাঁর পীরের রূহানী তাওয়াজ্জোহ্ এর বদৌলতে নিজের ক্বলব জিন্দা করে নিতে পারেন। এর নিম্ন সময়সীমা মুরিদ হবার সঙ্গে সঙ্গে। ঊর্ধ সময়সীমা চল্লিশ দিন। এর পরের স্তরসমূহও অতিক্রম করা যায় অতি দ্রুত এবং অত্যন্ত সহজে।
একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, তরিকা পৌঁছায় না। পৌঁছায় পীর। অর্থাৎ যত শানদার তরিকাই হোক, সেই তরিকার পূর্ন কামালিয়াতসম্পন্ন পীরই কেবল মুরিদগণকে মকসুদ মঞ্জিলে পৌঁছানোর ব্যাপারে রূহানী সহযোগীতা প্রদান করতে পারেন। পীরের কামালিয়াত না থাকলে শুধুমাত্র তরিকার নামে বায়াত হলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।
আমরা মুসলমান। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে রসূল (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র বাণী, কুল্লু মুসলিমুন ইখ্ওয়াতুন। সকল মুসলমান ভাই ভাই। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ্র কালাম, উম্মাতুন ওয়াহিদাতুন—তোমরা তো একই জাতি। আজ মুসলমানদের দুর্দিন। সকল পৃথিবী জুড়ে আমরাই আজ সবার চাইতে বেশী অবহেলিত, লাঞ্ছিত। আমাদের নবী মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্ (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) যেমন নবীগণের ইমাম তেমনি আমাদেরও হবার কথা পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়ের ইমাম বা নেতা। কিন্তু বাস্তব আমাদেরকে কি দৃশ্য দেখাচ্ছে ? কি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেক, কি মুসলমান সংখ্যালঘু দেশ—সবস্থানেই আমরা লাঞ্ছিত, অপদস্থ। কোথাও সম্পদের প্রাচুর্যের কারনে আমরা প্রবৃত্তির পীড়নের শিকার। আবার কোথাও দারিদ্র, অশিক্ষা ও সংখ্যালঘুতার কারনে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা নিগৃহীত।
এ অবস্থা থেকে আমাদের আশু উত্তরণ প্রয়োজন। হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজন আত্নসমালোচনায় নিমগ্ন হয়ে নিজেরদের দোষত্রুটি থেকে মুক্তের সাধনা। আমরা যারা যে স্তরেরই লোক হই না কেন—কৃষক শ্রমিক থেকে রাষ্ট্রের কর্নধার, সবারই মূল পরিচয়, আমরা আল্লাহ্ পাকের বান্দা—রসুলেপাক (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর উম্মত। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের উপরে দায়িত্ব দেশে ইসলামী আইন কানুন প্রবর্তন করা। যাতে করে মানুষের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহপাকের আইনই আইন। হে রাষ্ট্রপ্রধানগণ! কোন্ সাহসে আপনারা আল্লাহ্র জমিনে আল্লাহর দ্বীন-বিরোধী আইন জিইয়ে রেখেছেন ? মনে রাখবেন, আখেরাতে আল্লাহ্র সম্মুখে আপনাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
আলেমগনের উপরে দায়িত্ব—দ্বীনের শিক্ষায় সকল শ্রেণীর মুসলমানকে উজ্জীবিত করা। কোরআন হাদিসের ভিত্তিতে সমকালীন যুগজিজ্ঞাসার ফয়সালা করা, শরীয়তের শান শওকত বুলন্দ করা। আপনারা নিজেদেরকে নায়েবে রসূল বলে মনে করেন। কিন্তু কোথায় সেই কোরবানি, ত্যাগ? হে আলেম সম্প্রদায় ভেবে দেখুন, আপনারা কি নায়েবে রসূলের দায়িত্ব পালনে তৎপর রয়েছেন ? সম্মান, কর্তৃত্ব, অর্থ, খ্যাতি লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকে আপনারা কি বিস্মৃত হননি মহানবী (সাল্লালাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম) এর বাণী, ‘আখেরাতে ঐ আলেমের সবচেয়ে বেশী শাস্তি হবে—যে তাঁর এলেম দ্বারা উপকৃত হয়নি’।
সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব—মানুষের অন্তর্জগতে আল্লাহ্প্রেমের নূরপ্রবাহ জারী করবার মহান কাজে আঞ্জাম দেয়া। কিন্তু কি হচ্ছে বাস্তবে ? হে সূফী সম্প্রদায়! অর্থ উপার্জন, নজরানা, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, গান-বাজনা, প্রতিপত্তিশালী মানুষের মোসাহেবী—এসবই হয়ে উঠেছে আপনাদের মূল উদ্দেশ্য। দ্বীনের খাদেম বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে দ্বীনের দুশমনির কাজে আপনারা লিপ্ত হয়েছেন কেন ?
দ্বীনের দুশমন তিনটি দল। দুনিয়াদার বাদশাহ্, দুনিয়াদার আলেম (ওলামায়) এবং ভণ্ড সূফী। এই তিন দলের এছলাহ্ (সংশোধন) না হলে দ্বীনের শান বিকশিত হতে পারে না। দ্বীনদার রাষ্ট্রনায়ক, দ্বীনদার আলেম এবং কামেল সূফীই দ্বীনকে সমুন্নত করবার মহান কাজের আঞ্জাম দিতে পারেন।
সাধারণ মুসলমানকে দ্বীন বিকৃত করবার দায়ে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নন। তবুও তাঁরা সম্পূর্নভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। দ্বীনের জ্জানার্জন করবার জন্য দ্বীনদার আলেম এবং কামেল পীরের শরণাপন্ন হওয়া তাঁদের জন্যও জরুরী। কিন্তু তাঁরা আলেম ও পীরের শরণাপন্ন হন দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে। আর তাঁদের প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবসা বিস্তার করে বসেছে আলেম ও পীর সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ।
আর এক দিকে বয়ে যাচ্ছে ইসলামবিরোধী মতবাদের সয়লাব। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ অনৈসলামিক মতবাদের অন্ধকারে ক্রমশঃ নিমজ্জমান। তারাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাঁরা ইসলাম বিরোধী মতবাদের বিরাটাকায় গ্রন্থ অধ্যয়নে, অনুশীলনে ও গবেষণায় সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকেন, কিন্তু কোরআন হাদিসের শিক্ষার প্রতি এতটুকু দৃষ্টিপাত করবার সময় তাঁদের নেই। তাঁরা কি জানেন না—দ্বীনের জ্ঞানার্জন, শরীয়তের হুকুম শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শ্রমিক, কৃষক, শিল্পপতি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবী সকলের উপর ফরজ।
আমাদের রাষ্ট্রনায়কগণ, আমাদের আলেম সমাজ, আমাদের মাশায়েখবৃন্দ, আমাদের সমাজ সচেতন শিক্ষিত সম্প্রদায়—আমরা সবাই মুসলমান জামাতের অন্তর্ভুক্ত, আমাদের কারো পদস্খলনে আমরা কেউই উদাসীন থাকতে পারি না। আমরা সবাই তো একক জাতি।। উম্মাহাতুল ওয়াহিদুন। আমরা জানি আমাদের কোন অঙ্গ দূর্বলতার শিকার হলে তাতে আমাদেরই ক্ষতি, তাতে আমাদেরই শক্তি খর্ব হয়। তাই আমরা আমাদের সম্মিলিত আত্মসমালোচনার অংশ হিসেবে প্রত্যেকেই নিজেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভাল করে বিবেচনা করে দেখিঃ
১) আমাদের আকীদা ঠিক কিনা ?
২) আমাদের দ্বীনের এলেমের দুইটি ধারাকেই (জবানী এলেম ও কলবী এলেম) সমান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি কিনা ?
৩) এলেম অনুযায়ী আমল করছি কিনা ?
৪) এখলাছ অর্জনের জন্য যুগোপযোগী তরিকায় দাখেল হয়েছি কিনা ?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলির বাস্তব জবাব দ্বারা আমাদের প্রত্র্যকের ব্যক্তিগত জীবন সজ্জিত করতে হবে পারিবারিক জীবনে, সমাজ জীবনে এবং আন্তর্জাতিক জীবনে। তবেই আমাদের সমষ্টিগত জীবনে কায়েম হবে পূর্ন দ্বীন। তবেই তবলীগ, একামাতে দ্বীন, জেহাদের হক আদায় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
যে ব্যক্তি তাঁর নিজের অস্তিত্বে রাজত্বে পূর্ন দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম নয়, সে কি কখনো রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামাজিক জীবনে দ্বীন কায়েম করতে সক্ষম হতে পারে ? কখনই নয়।
অতএব, হে মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ! আসুন হুশিয়ার হই। সমাজে দেশে ও বিশ্বে পূর্ন দ্বীন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সামনে রেখে প্রথমেই নিজেদেরকে পূর্ন দ্বীনের সাজে সজ্জিত করবার সাধনায় নিয়োজিত হই আমরা।
ওয়াস্সালামো আউয়ালাঁও ওয়া আখেরান।