পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিরোধীতাকারী ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়ের নেতাদের দাবী হচ্ছে এটি কুর’আন-হাদীসে নেই, সালফে-সালেহীনদের কেউই তা পালন করেন নি। তাই তা পালন করা হারাম, শিরক ও বিদ’আত।
মিলাদুন্নাবীﷺপালন ইসলামি শারীয়াতের মধ্যেই পড়ে। আমরা এখানে বেশ কয়েকটি পর্বে তা কুর'আন, সহীহ হাদীস ও খ্যাতিমান/স্ববানামধন্য আলেমগণের মন্তব্যের দ্বারা তা প্রমাণ করব। সবগুলো পোষ্ট পড়লেই যে কেউই সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।
আমরা মহাগ্রন্থ আল কুর'আনের আলোকে প্রমাণ করব এই দিবস পালনের যৌক্তিকতা।
এ পৃথিবীতে যত নেয়ামত রয়েছে বা এসেছে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম। আল্লাহর এ নেয়ামত ও আনুগ্রহকে কেন্দ্র করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মীলাদ বা জন্ম তথা দুনিয়ায় শুভাগমনের কথা আলোচনা করেছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামীন নিজে। এর পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও আনন্দ করার নির্দিশও তিনি নিজে দিয়েছেন। যেমনঃ
১. নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের থেকে এমন একজন রাসূল এসেছেন যাঁর নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী এবং মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়। [সূরা তাওবা ১১৮]
২. হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) মহান আল্লাহ তা’আলা এর দরবারে ফারিয়াদ জানান, ওহে প্রভু তাঁদের মধে তাঁদের হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি আপনার বাণীসমূহ তাঁদেরকে পাঠ করে শুনাবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিয়ে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনিও অতিশয় পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী। [সূরা বাকারা ১২৯]
এখানে দেখা যায় হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আবির্ভাবের ৪ হাজার বছর পূর্বেই মুনাজাত আকারে তাঁর আবির্ভাব, তাঁর সারা জীবনের কর্ম চাঞ্চল্য ও মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধির ক্ষমতার বর্ণনা হুজুরﷺ এর মিলাদের সারাংশ পাঠ করেছেন এবং এই মুনাজাত বা মিলাদ দন্ডায়মান অবস্থায়ই করেছেন। ইবন তায়্যিমিয়ার ছাত্র ইমাম ইবন কাসীর (রঃ) তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা' তে লিখেছেন
"উক্ত দোয়া করার সময় ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) দন্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন"। [আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা, ২য় খন্ড, পৃ ২৬১]
এখান থেকে খুব সহজেই বুঝা যায়, বর্তমানে মিলাদ শারীফে রাসূল পাকের আগমনের যে বর্ণনা দেয়া হয় তা ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর দোয়ার সামান্য অংশ মাত্র। সুতরাং আমাদের মিলাদ শারীফ পাঠ ও কিয়াম করা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নাতি তরিকা।
৩. যখন ঈসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাইলকে বললেন, আমি আল্লাহ এর রাসূল হিসেবে তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি। তার সঙ্গে আমার সাথে যে তাওরাত এসেছে তার প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে এবং আমার পর যে রাসূল আসবেন তার নাম হবে আহমদ। ঐ রাসূলের সুসংবা নিয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। আর যখন সে রাসূল তাদের নিকট দলীলসমূহ সহকারে আসলেন, তখন তারা বলতে লাগল এটা প্রকাশ্য যাদু। [সূরা ছফ ৬]
হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর ভাষণ দন্ডায়মান অবস্থায় হত। আর এটাই ভাষণের সাধারণ রীতিও বটে। ইমাম ইবন কাসীর (রঃ) তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা' তে উল্লেখ করেন
"ঈসা (আলাইহিস সালাম) দন্ডায়মান অবস্থায় (কিয়াম) অবস্থায় তাঁর উম্মাতহাওয়ারীদেরকে নবীজীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন"। [আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা, ২য় খন্ড, পৃ ২৬১]
সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নাত এবং তা নবী যুগের ৫৭০ বছর পূর্ব হতেই।
৪. নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মহান ‘নূর’ [মহানবী ﷺ] এবং ষ্পষ্ট কিতাব (আল কুর’আন) এসেছে। [সূরা মায়িদা ১৫]
৫. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত নবী তথা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত যত নবী দুনিয়ায় আগমণ করেছেন, তাদের সবাইকে নিয়ে একটি মজলিস বা সভা করেছেন। এই মজলিসে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত ছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন ﷺ এর বিলাদাত, শান ও মান অন্যান্য নবীগণের সামনে তুলে ধরে মীলাদ বা দুনিয়ায় আগমনের বাণী শোনানো রাসূলﷺএর প্রতি সকল নবীর এর পক্ষ থেকে ঈমান গ্রহণের পক্ষ নিয়ার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন
"স্মরণ করুন যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে এমর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করব। তারপর তোমাদের নিকট তাশরীফ আনবেন রাসূল ﷺ। যিনি তোমাদের কিতাবগুলো সত্যায়ন করবেন। তখন তোমরা নিশ্চয়ই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্ছয়ই তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলে? সবাই আরজ করল, আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন, তোমরা একে অপরের উপরের সাক্ষী হয়ে যাও। আমি নিজেও তোমাদের সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম। সুতরাং যে কেউ এরপর ফিরে যাবে, তবে সে লোক ফাসিক"। [সূরা আল ইমরান ৮১, ৮২]
উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে মিলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর দুনিয়ায় শুভাগমনের কথা তথা মিলাদের আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত নবীজীর সম্মানে এটাই ছিল সর্ব প্রথম মিলাদ মাহফিল এবং এর উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে। সমস্ত নবীগণ খোদার দরবারে দন্ডায়মান থেকে মিলাদ শুনেছিলেন এবং কিয়াম করেছিলেন। কেননা খোদার দরবারে বসার কোনো অবকাশ নেই। পরিবেশটি ছিল খুবই আদবের। মিলাদ পাঠকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা এবং কিয়ামকারীগণ ছিলেন আম্বিয়ায়ে কিরাম। ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা ফতওয়া দেয় মিলাদুন্নাবী ﷺ) পালন করা ‘শিরক’-‘বিদ’আত’-‘বিধর্মীদের নীতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব জানতে ইচ্ছা করে এদের মত ফতওয়াবাজেরা এই ক্ষেত্রে কি ফতওয়া দিবে! ! !
মীলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর দুনিয়ায় আগমনের ঈদ বা আনন্দ উৎসব করার দলীল পবিত্র কুর’আনের এই আয়াতটি
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَ بِرَحْمَتِهِ فَبِذَالِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَا خَىْرٌ مِمَّا ىَجْمَعُوْنَ
আর্থাৎ- "হে রাসুল আপনি বলুন আল্লাহর “অনুগ্রহ” ও “রহমত” প্রাপ্তিতে তাঁদের মুমিনদের খুশি উদযাপন করা উচিত এবং এটা হবে তাদের অর্জিত সকল কর্মফলের চেয়েও শ্রেষ্ট"। [সুরা ঈউনূছ,আয়াত ৫৮]
# এই আয়াতের ব্যাখ্যা ৯ম শতাব্দী মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আদ্দুররুল মনসূর’ এ উল্লেখ করেন,
"হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, এখানে আল্লাহ এর “অনুগ্রহ” দ্বারা ইলমে দ্বীন এবং “রহমত” দ্বারা নবী কারীম ﷺ এর কথা বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হে হাবীব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতি রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি"। [আদ্দুররুল মনসূর পৃঃ ৩৩০]
# এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসি (রঃ) তাঁর স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে উল্লেখ করেন,
"হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই ‘অনুগ্রহ’ হল ইলমে দ্বীন এবং ‘রহমত’ হল নবী কারীম ﷺ"। [তাফসীর রুহুল মা’আনী ১১তম খন্ড, পৃঃ ১৮৩]
সুতরাং আলোচ্য আয়াত এবং তাফসীরের মাধ্যমে বুঝা গেল, মিলাদুন্নাবী বা রাসূলﷺ এর দুনিয়ায় শুভাগমনের কারণে স্বয়ং আল্লাহ পাক নিজে আমাদের আনন্দ উৎসব করার আদেশ দিয়েছেন। আর মিলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর আগমন উপলক্ষে আনন্দ-উতসব বা খুশী উদযাপন করার নামই হল পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী ﷺ।
ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা আলোচ্য আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যায় আল্লাহ এর অনুগ্রহ ও রহমত বলতে শুধু ইসলাম ও কুরআনকেই বুঝাতে চায়। তাদের প্রতি অনুরোধ রইল তাঁরা যেন উক্ত তাফসীর গ্রন্থসমূহ ভালভাবে অধ্যায়ন করেন। তারপরও তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য রাসূল ﷺ যে আল্লাহ এর রহমত ও করুণাস্বরূপ সেই বিষয়ে কুর’আনের কিছু আয়াত ও ব্যাখ্যা পেশ করলামঃ-
১. وما ارسلنك إلا رحمة للعالمين
"হে রাসূল, নিশ্চই আমি আপনাকে জগতসমুহের রহমত করেই প্রেরণ করেছি"। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭]
২. "আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, যদি তোমাদের উপর আল্লাহ এর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত তবে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হতে"। [সূরা আল-বাকারা ৮৪]
এই আয়াতের ব্যাখ্যা তাফসীর মা’রেফুল কুর’আনের ৮৪ পৃষ্ঠায় বলে আছে,
"আর হাদীসের বর্ণনার ভিত্তিতে আযাব অবতীর্ণ না হওয়াটা মহানবী ﷺ এরই বরকত। কাজেই কোনো কোনো তাফসীরকারক মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবকেই অর্থাৎ মিলাদুন্নাবী ﷺ কেই আল্লাহ এর রহমত ও করুণা বলে বিশ্লেষণ করেছেন"।
৩. "আল্লাহ মুমিনদের উপর অবশ্যই এ অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন"। [সূরা আল-ইমরান ১৬৪]
৪. "যারা আল্লাহ এর নিয়ামতকে কুফরী বশত পরিবর্তন করেছে"। [সূরা ইব্রাহীম ২৮]
এ আয়াতের ব্যাখ্যা বুখারী শারীফের ২য় খন্ডের ৫৬৬ পৃষ্ঠায় আছে, হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, যারা আল্লাহ এর নিয়ামত পরিবর্তন করেছে আলাহ এর কসম তারা হল কুরাইশ গোত্রের কাফিরগণ। হযরত আমর (রাঃ) বলেন, যারা আল্লাহ এর নিয়ামত পরিবর্তন করেছে তারা হল কুরাইশ। আর মুহাম্মাদﷺহলেন আল্লাহ এর নিয়ামত। এর মাধ্যমে ষ্পষ্টভাবে প্রমাণীত যে রাসূলে কারীম ﷺ আল্লাহ এর রহমত, অনুগ্রহ, করুণা ইত্যাদি।
সুতরাং যারা রাসূল ﷺ কে আল্লাহ এর রহমত বা অনুগ্রহ স্বীকার করতে চান না, তারা নিঃসন্দেহে গোমরায় নিমজ্জিত। আমরা পবিত্র কুর’আন ও ইসলামকেও আল্লাহ এর রহমত ও অনুগ্রহ হিসেবে স্বীকার করি। রাসূল ﷺ, কুর’আন ও ইসলাম সবই আল্লাহ তা’আলার রহমত, অনুগ্রহ ও নিয়ামত। আর এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হল রাসূল ﷺ।
তাই তো পবিত্র কুর’আন এ আল্লাহ তা’আলা মহানবী ﷺ এর দিন মুমিনদের খুশী হতে বলেছেন। কেননা ইবলিশ শয়তান জীবনে ঠিক এই সময়টাতেই খুব বেশি কেঁদেছে বা আফসোস করেছে।
أن إبليس رن أربع رنات حين لعن وحين أهبط وحين ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم وحين أنزلت الفاتحة
১. আল্লাহ যখন তাকে অভিশপ্ত হিসেবে ঘোষণা দিলেন,
২. যখন তাকে বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত করা হল,
৩. নূর নবীজীর ﷺ দুনিয়াতে আগমনের সময় এবং
৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হবার সময়
[সূত্রঃ ইবন কাসির, আল আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা - ১৬৬]
অতএব, পবিত্র কুর’আন এর মাধ্যমে মিলাদুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণীত হল নিঃসন্দেহে।
মিলাদুন্নাবীﷺপালন ইসলামি শারীয়াতের মধ্যেই পড়ে। আমরা এখানে বেশ কয়েকটি পর্বে তা কুর'আন, সহীহ হাদীস ও খ্যাতিমান/স্ববানামধন্য আলেমগণের মন্তব্যের দ্বারা তা প্রমাণ করব। সবগুলো পোষ্ট পড়লেই যে কেউই সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।
আমরা মহাগ্রন্থ আল কুর'আনের আলোকে প্রমাণ করব এই দিবস পালনের যৌক্তিকতা।
এ পৃথিবীতে যত নেয়ামত রয়েছে বা এসেছে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম। আল্লাহর এ নেয়ামত ও আনুগ্রহকে কেন্দ্র করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মীলাদ বা জন্ম তথা দুনিয়ায় শুভাগমনের কথা আলোচনা করেছেন স্বয়ং রাব্বুল আলামীন নিজে। এর পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও আনন্দ করার নির্দিশও তিনি নিজে দিয়েছেন। যেমনঃ
১. নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তোমাদের থেকে এমন একজন রাসূল এসেছেন যাঁর নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী এবং মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়। [সূরা তাওবা ১১৮]
২. হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) মহান আল্লাহ তা’আলা এর দরবারে ফারিয়াদ জানান, ওহে প্রভু তাঁদের মধে তাঁদের হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি আপনার বাণীসমূহ তাঁদেরকে পাঠ করে শুনাবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিয়ে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনিও অতিশয় পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী। [সূরা বাকারা ১২৯]
এখানে দেখা যায় হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আবির্ভাবের ৪ হাজার বছর পূর্বেই মুনাজাত আকারে তাঁর আবির্ভাব, তাঁর সারা জীবনের কর্ম চাঞ্চল্য ও মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধির ক্ষমতার বর্ণনা হুজুরﷺ এর মিলাদের সারাংশ পাঠ করেছেন এবং এই মুনাজাত বা মিলাদ দন্ডায়মান অবস্থায়ই করেছেন। ইবন তায়্যিমিয়ার ছাত্র ইমাম ইবন কাসীর (রঃ) তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা' তে লিখেছেন
"উক্ত দোয়া করার সময় ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) দন্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন"। [আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা, ২য় খন্ড, পৃ ২৬১]
এখান থেকে খুব সহজেই বুঝা যায়, বর্তমানে মিলাদ শারীফে রাসূল পাকের আগমনের যে বর্ণনা দেয়া হয় তা ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর দোয়ার সামান্য অংশ মাত্র। সুতরাং আমাদের মিলাদ শারীফ পাঠ ও কিয়াম করা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নাতি তরিকা।
৩. যখন ঈসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাইলকে বললেন, আমি আল্লাহ এর রাসূল হিসেবে তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি। তার সঙ্গে আমার সাথে যে তাওরাত এসেছে তার প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে এবং আমার পর যে রাসূল আসবেন তার নাম হবে আহমদ। ঐ রাসূলের সুসংবা নিয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। আর যখন সে রাসূল তাদের নিকট দলীলসমূহ সহকারে আসলেন, তখন তারা বলতে লাগল এটা প্রকাশ্য যাদু। [সূরা ছফ ৬]
হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর ভাষণ দন্ডায়মান অবস্থায় হত। আর এটাই ভাষণের সাধারণ রীতিও বটে। ইমাম ইবন কাসীর (রঃ) তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা' তে উল্লেখ করেন
"ঈসা (আলাইহিস সালাম) দন্ডায়মান অবস্থায় (কিয়াম) অবস্থায় তাঁর উম্মাতহাওয়ারীদেরকে নবীজীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন"। [আল-বিদায়্যা ওয়ান নিহায়্যা, ২য় খন্ড, পৃ ২৬১]
সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নাত এবং তা নবী যুগের ৫৭০ বছর পূর্ব হতেই।
৪. নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মহান ‘নূর’ [মহানবী ﷺ] এবং ষ্পষ্ট কিতাব (আল কুর’আন) এসেছে। [সূরা মায়িদা ১৫]
৫. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত নবী তথা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত যত নবী দুনিয়ায় আগমণ করেছেন, তাদের সবাইকে নিয়ে একটি মজলিস বা সভা করেছেন। এই মজলিসে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত ছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন ﷺ এর বিলাদাত, শান ও মান অন্যান্য নবীগণের সামনে তুলে ধরে মীলাদ বা দুনিয়ায় আগমনের বাণী শোনানো রাসূলﷺএর প্রতি সকল নবীর এর পক্ষ থেকে ঈমান গ্রহণের পক্ষ নিয়ার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন
"স্মরণ করুন যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে এমর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করব। তারপর তোমাদের নিকট তাশরীফ আনবেন রাসূল ﷺ। যিনি তোমাদের কিতাবগুলো সত্যায়ন করবেন। তখন তোমরা নিশ্চয়ই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্ছয়ই তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলে? সবাই আরজ করল, আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেন, তোমরা একে অপরের উপরের সাক্ষী হয়ে যাও। আমি নিজেও তোমাদের সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম। সুতরাং যে কেউ এরপর ফিরে যাবে, তবে সে লোক ফাসিক"। [সূরা আল ইমরান ৮১, ৮২]
উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে মিলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর দুনিয়ায় শুভাগমনের কথা তথা মিলাদের আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত নবীজীর সম্মানে এটাই ছিল সর্ব প্রথম মিলাদ মাহফিল এবং এর উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে। সমস্ত নবীগণ খোদার দরবারে দন্ডায়মান থেকে মিলাদ শুনেছিলেন এবং কিয়াম করেছিলেন। কেননা খোদার দরবারে বসার কোনো অবকাশ নেই। পরিবেশটি ছিল খুবই আদবের। মিলাদ পাঠকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা এবং কিয়ামকারীগণ ছিলেন আম্বিয়ায়ে কিরাম। ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা ফতওয়া দেয় মিলাদুন্নাবী ﷺ) পালন করা ‘শিরক’-‘বিদ’আত’-‘বিধর্মীদের নীতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব জানতে ইচ্ছা করে এদের মত ফতওয়াবাজেরা এই ক্ষেত্রে কি ফতওয়া দিবে! ! !
মীলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর দুনিয়ায় আগমনের ঈদ বা আনন্দ উৎসব করার দলীল পবিত্র কুর’আনের এই আয়াতটি
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَ بِرَحْمَتِهِ فَبِذَالِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَا خَىْرٌ مِمَّا ىَجْمَعُوْنَ
আর্থাৎ- "হে রাসুল আপনি বলুন আল্লাহর “অনুগ্রহ” ও “রহমত” প্রাপ্তিতে তাঁদের মুমিনদের খুশি উদযাপন করা উচিত এবং এটা হবে তাদের অর্জিত সকল কর্মফলের চেয়েও শ্রেষ্ট"। [সুরা ঈউনূছ,আয়াত ৫৮]
# এই আয়াতের ব্যাখ্যা ৯ম শতাব্দী মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আদ্দুররুল মনসূর’ এ উল্লেখ করেন,
"হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, এখানে আল্লাহ এর “অনুগ্রহ” দ্বারা ইলমে দ্বীন এবং “রহমত” দ্বারা নবী কারীম ﷺ এর কথা বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হে হাবীব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতি রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি"। [আদ্দুররুল মনসূর পৃঃ ৩৩০]
# এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসি (রঃ) তাঁর স্বীয় তাফসীরগ্রন্থে উল্লেখ করেন,
"হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই ‘অনুগ্রহ’ হল ইলমে দ্বীন এবং ‘রহমত’ হল নবী কারীম ﷺ"। [তাফসীর রুহুল মা’আনী ১১তম খন্ড, পৃঃ ১৮৩]
সুতরাং আলোচ্য আয়াত এবং তাফসীরের মাধ্যমে বুঝা গেল, মিলাদুন্নাবী বা রাসূলﷺ এর দুনিয়ায় শুভাগমনের কারণে স্বয়ং আল্লাহ পাক নিজে আমাদের আনন্দ উৎসব করার আদেশ দিয়েছেন। আর মিলাদুন্নাবী বা রাসূল ﷺ এর আগমন উপলক্ষে আনন্দ-উতসব বা খুশী উদযাপন করার নামই হল পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী ﷺ।
ওহাবী-খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা আলোচ্য আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যায় আল্লাহ এর অনুগ্রহ ও রহমত বলতে শুধু ইসলাম ও কুরআনকেই বুঝাতে চায়। তাদের প্রতি অনুরোধ রইল তাঁরা যেন উক্ত তাফসীর গ্রন্থসমূহ ভালভাবে অধ্যায়ন করেন। তারপরও তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের জন্য রাসূল ﷺ যে আল্লাহ এর রহমত ও করুণাস্বরূপ সেই বিষয়ে কুর’আনের কিছু আয়াত ও ব্যাখ্যা পেশ করলামঃ-
১. وما ارسلنك إلا رحمة للعالمين
"হে রাসূল, নিশ্চই আমি আপনাকে জগতসমুহের রহমত করেই প্রেরণ করেছি"। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭]
২. "আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, যদি তোমাদের উপর আল্লাহ এর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত তবে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হতে"। [সূরা আল-বাকারা ৮৪]
এই আয়াতের ব্যাখ্যা তাফসীর মা’রেফুল কুর’আনের ৮৪ পৃষ্ঠায় বলে আছে,
"আর হাদীসের বর্ণনার ভিত্তিতে আযাব অবতীর্ণ না হওয়াটা মহানবী ﷺ এরই বরকত। কাজেই কোনো কোনো তাফসীরকারক মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবকেই অর্থাৎ মিলাদুন্নাবী ﷺ কেই আল্লাহ এর রহমত ও করুণা বলে বিশ্লেষণ করেছেন"।
৩. "আল্লাহ মুমিনদের উপর অবশ্যই এ অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন"। [সূরা আল-ইমরান ১৬৪]
৪. "যারা আল্লাহ এর নিয়ামতকে কুফরী বশত পরিবর্তন করেছে"। [সূরা ইব্রাহীম ২৮]
এ আয়াতের ব্যাখ্যা বুখারী শারীফের ২য় খন্ডের ৫৬৬ পৃষ্ঠায় আছে, হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, যারা আল্লাহ এর নিয়ামত পরিবর্তন করেছে আলাহ এর কসম তারা হল কুরাইশ গোত্রের কাফিরগণ। হযরত আমর (রাঃ) বলেন, যারা আল্লাহ এর নিয়ামত পরিবর্তন করেছে তারা হল কুরাইশ। আর মুহাম্মাদﷺহলেন আল্লাহ এর নিয়ামত। এর মাধ্যমে ষ্পষ্টভাবে প্রমাণীত যে রাসূলে কারীম ﷺ আল্লাহ এর রহমত, অনুগ্রহ, করুণা ইত্যাদি।
সুতরাং যারা রাসূল ﷺ কে আল্লাহ এর রহমত বা অনুগ্রহ স্বীকার করতে চান না, তারা নিঃসন্দেহে গোমরায় নিমজ্জিত। আমরা পবিত্র কুর’আন ও ইসলামকেও আল্লাহ এর রহমত ও অনুগ্রহ হিসেবে স্বীকার করি। রাসূল ﷺ, কুর’আন ও ইসলাম সবই আল্লাহ তা’আলার রহমত, অনুগ্রহ ও নিয়ামত। আর এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হল রাসূল ﷺ।
তাই তো পবিত্র কুর’আন এ আল্লাহ তা’আলা মহানবী ﷺ এর দিন মুমিনদের খুশী হতে বলেছেন। কেননা ইবলিশ শয়তান জীবনে ঠিক এই সময়টাতেই খুব বেশি কেঁদেছে বা আফসোস করেছে।
أن إبليس رن أربع رنات حين لعن وحين أهبط وحين ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم وحين أنزلت الفاتحة
১. আল্লাহ যখন তাকে অভিশপ্ত হিসেবে ঘোষণা দিলেন,
২. যখন তাকে বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত করা হল,
৩. নূর নবীজীর ﷺ দুনিয়াতে আগমনের সময় এবং
৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হবার সময়
[সূত্রঃ ইবন কাসির, আল আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা - ১৬৬]
অতএব, পবিত্র কুর’আন এর মাধ্যমে মিলাদুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রমাণীত হল নিঃসন্দেহে।