ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ এ বিষয়ে একমত যে, হুযুর সাইয়্যিদ আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পবিত্র সত্ত্বা যাবতীয় গুণাবলীতে ভূষিত। অর্থাৎ যে সব গুণাবলী অন্যান্য সম্মানিত নবী কিংবা ভবিষ্যতে আগমনকারী উচ্চ পর্যায়ের ওলীগণ বা কোন সৃষ্টজীব লাভ করেছেন বা করবেন, সে সমস্ত গুণাবলী বরং তার চেয়েও বেশী গুণাবলীতে হুযুর আলাইহিস সলামকে ভূষিত করা হয়েছে। বরং অন্যান্য সকলেই যা কিছু অর্জন করেছেন, তা সব হুযুর আলাইহিস সালামের বদৌলতে। কুরআন কারীম ইরশাদ করেছেন- (আপনি পূর্ববর্তী নবীগণের পথে চলুন।) তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ কথার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- فَجَمَعَ اللهُ كُلَّ خَصْلَةٍ فِىْ حَبِيْبِه عَلَيْهِ السَّلَامُ অর্থাৎ আল্লাহ হুযুর আলাইহিস সালামকে প্রত্যেক নবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেছেন। এ কথাটুকু মওলানা জামী (রহঃ) এ কবিতার নিম্নোক্ত পংক্তিদ্বয়েও বিধৃত হয়েছে-
[স্বনামধন্য কবি হুযুর আলাইহিস সালামকে সম্বোধন করে বলেছেন হে নবী! আপনি হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর অপূর্ব সৌন্দর্য রাশিতে ভূষিত, হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এ ফুঁক দিয়ে জীবন দানের ক্ষমতা সম্পন্ন ও হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) (এর য়াদে বায়যার) একটি হাত বগলেন নিচে এনে বের করলে উজ্জ্বলরূপে ভাস্বর হওয়ার মুজিযা) অধিকারী। যে সব গুণাবলী পূর্ববর্তী নবীগণ পৃথক পৃথকভাবে লাভ করেছিলেন সব গুণাবলী আপনার মধ্যে সামগ্রিকরূপে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।]
মওলভী কাসেম সাহেব তার রচিত তাহযীরুন্নাস গ্রন্থের ৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- অন্যান্য নবীগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসালাম থেকে গ্রহণ করেই তাদের নিজ নিজ উম্মতকে ফয়েয দান করেছেন। মোট কথা অন্যান্য নবীগণের মধ্যে যেসব গুণাবলী নিহিত আছে সেগুলি হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণাবলীর ছায়া বা প্রতিফলিত রুপ। এ প্রসঙ্গে কুরআন হাদীছ ও সুপ্রসিদ্ধ আলেমগণের উক্তি থেকে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীগণও এ কথাটি স্বীকার করেন বিধায় সে কথার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ নিষ্প্রয়োজন। এখন স্বীকৃত সিদ্ধান্ত হলো, কেউ যদি পূর্ণতা জ্ঞাপক কোন গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন, তাহলে সে গুণে পুর্ণরূপে ভূষিত হয়েছেন হুযুর আলাইহিস সালাম। এ নিয়মানুযায়ী সব জায়গায় হাযির-নাযিরহওয়ার ক্ষমতা যেহেতু অনেক মাখলুককে দান করা হয়েছে, সেহেতু স্বীকার করতেই হয় যে, এ গুণও হুযুর আলাইহিস সালামকে দান করা হয়েছে।
হাযির-নাযির হওয়ার ক্ষমতা কোন কোন সৃষ্ট জীবকে দান করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে এখন আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি। আমি হাযির-নাযির শীর্ষিক আলোচনার ভূমিকায় বলেছি যে, হাযির-নাযির হওয়ার তিনটি মানে আছেঃ এক জায়গায় থেকে সমস্ত জগতকে হাতের তালুর মত দেকতে পাওয়া নিমেষেই সমগ্র জগত পরিভ্রমণ করা ও শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থানকারী কাউকে সাহায্য করা এবং পার্থিব শরীর কিংবা অনুরূপ শরীর নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যমান হওয়া। এসব গুণাবলী অনেক সৃষ্টজীবের মধ্যেও নিহিত আছে।
১) রূহুল বয়ান খাযেন; তাফসীরে কবীর ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থ সমূহ ৭ম পারার সুরা আনআম এর আয়াত حَتَّى اِذَا جَاءَ اَحَدَ كُمُالْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছেঃ
جُعِلَتِ الْاَرْضُ لملَكَ الْمَوْتِ مِثْلَ الطَّشْتِ يَتَنَاوَلُ مِنْ حَيْثُ شَاء
অর্থাৎ মলকুল মওত এর জন্য সমগ্র ভূ-খণ্ডকে এমন একটি থালার মত করে দেওয়া হয়েছে যে, তার ইচ্ছানুযায়ী সেই থালা থেকে তিনি নিতে পারেন।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ জায়গায় আরও বলা হয়েছে-
لَيْسَ عَلَى مَلَكِ الْمَوْتِ صَعُوْبَةٌ فِىْ قَبْضِ الْاَرْوَاحِ وَاِنْ كَثُرَتْ وَكَانَتْ فِىْ اَمْكِنَةٍ مُتَعَدِّدَةٍ
অর্থাৎ মলকুল মওতের রূহসমূহ কবজ করতে কোন বেগ পেতে হয় না যদিও রূহ সংখ্যায় বেশী হয় ও বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে থাকে। তাফসীরে খাযেনে সে একই আয়াতের নিচে লিখা হয়েছে-
مَامِنْ اَهْلِ بَيْتِ شَعْرٍ وَّلَامَدَرٍ اِلَّامَلَكُ الْمَوْتِ يُطِيْفُ بِهِمْ يَوْمًا مَرَّتَيْنِ
অর্থাৎ প্রতিটি তাবু বা ঘরে বসবাসকারী এমন কোন জীব নেই যার কাছে মলকুল মওত দিনে দুবার না যান।
মিশকাত শরীফের باب فضل الاذان শীর্ষক অধ্যায়ে আছেঃ যখন আযান ও তকবীর বলা হয়, তখন শয়তান ৩৬ মাইল দুরে পালিয়ে যায়; আবার যখন আযান-তকবীরের পালা শেষ হয়ে যায় সে পুনরায় উপস্থিত হয়। আগুন হতে সৃষ্ট জীবের গতির এ অবস্থা!
আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের একটি রূহ শরীর থেকে বের হয়ে জগতের এদিক সেদিক বিচরণ করে এ রূহকে বলা হয় রূহে সাইরানী (বিচরণকারী রূহ) যার প্রমাণ কুরআন পাকেও রয়েছে وَيُمْسِلُ اُخْرى আল্লাহ অপর রুহকে আবদ্ধ রাখেন। (যে মাত্র কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীরের পার্শ্বে দাড়িয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠাল, তখনই সে রূহ, যা মক্কায় কিংবা পবিত্র মদীনায় বিচরণ করছিল, তৎক্ষণাৎ শরীরে পুনঃ প্রবেশ করল, ঘুমন্ত ব্যাক্তি জেগে উঠল।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে وَهُوَ الَّذِيْ يَتَوَفَّكُمْ بِاللَّيْلِ الح আয়াতে ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
فَاِذَااِنْتَبَهَ مِنَ النَّوْمِ عَادَتِ الرُّوْحُ اِلَى جَسَدٍ بِاَسْرَعَ مِنْ لَّخْظَةٍ
অর্থাৎ মানুষ যখন ঘুম থেকে জেগে উঠে, এক মুহূর্তের চেয়েও কম সময়ে সে রূহ শরীরে ফিরে এসে যায়।
আমাদের দৃষ্টির নুর মুহূর্তেই সমস্ত জগত পরিভ্রমণ করে বিদ্যুৎ, তার, টেলিফোন ও লাউড স্পীকারের গতিশক্তির অবস্থা হচ্ছে আধা সেকেন্ডে ভূ- খন্ডের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অতিক্রম করে ফেলে। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর গতির অবস্থা হলো, হযরত ইউসুফ (আঃ) যখন কূপের অর্ধেক অংশ থেকে নিচের দিকে পতিত হচ্ছিলেন, সে মুহুর্তেই হযরত জিব্রাইল (আঃ) সিদরাতুল মুনতাহা থেকে যাত্রা করলেন, আর নিমেষেই হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কূপের তলায় পতিত হওয়ার পূর্বেই তাঁর নিকট পৌঁছে গেলেন। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে রুহুল বয়ানে আয়াত اَنْ يَّجْعَلُوْاهُ فِىْ غَيَابّةِ الْجُبِّ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য। হযরত ইব্রাহীম খলীল (আঃ) হযরত ঈসমাইল (আঃ) এর গলায় ছুরি চালালেন, ছুরি চলার আগেই জিব্রাইল (আঃ) সিদরা হতে দম্বা সমেত হযরত খলিলুল্লাহর (আঃ) খিদমতে হাযির হয়ে গেলেন। হযরত সুলাইমান (আঃ) এর উযীর আসিফ বিন বরখিয়া এক পলকেই রাণী বিলকিসের সিংহাসন ইয়ামন থেকে সিরিয়ায় হযরত সুলাইমান (আঃ) এর নিকট নিয়ে এলন, যার প্রমাণ কুরআন করীমেই রয়েছে।
বলা হয়েছেঃ-
اِنَّا اَتِيْكَ بِه قَبْلَ اَنْ يَّرْ تَدَّ اِلَيْكَ طَرْفُكَ
অর্থাৎ আমি আপনার চোখের পলক ফেলার আগেই সেটি নিয়ে আসছি। এ থেকে জানা গেল যে, হযরত আসিফের এ খবরও ছিল যে সিংহাসনটি কোথায় ছিল। লক্ষ্য করুন নিমিষেই তিনি ইয়মন গেলেন আর এত ভারী একটি সিংহাসন নিয়ে ফিরে এলেন। এখন প্রশ্ন হলো হযরত সুলাইমান (আঃ) এর সিংহাসন আনার এ ক্ষমতা ছিল কিনা? এ প্রসঙ্গে অত্র আলোচনার ২য় অধ্যায়ে ইনশাআল্লাহ আলোকপাত করব।
মিরাজের সময় সমস্ত নবী (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে হুযুর আলাইহিস সলাম এ পিছনে নামায আদায় করেছেন। নামাযের পর হুযুর আলাইহিস সালাম বুরাকে আরোহন পূর্বক অগ্রসর হচ্ছিলেন। বুরাকের গতির অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করুন। তার দৃষ্টি সীমার শেষ প্রান্তে তার এক পা পড়তো। অন্য দিকে নবীগণের দ্রুত গতির প্রতি লক্ষ্য করুন এখনই বায়তুল মুকাদ্দাসে তাঁরা ছিলেন মুক্তাদী, এখনই তারা বিভিন্ন আসমানে পৌঁছে গেলেন। হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, আমি অমুক আসমানে অমুক পয়গাম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। এ থেকে জানা যায় যে, বিদ্যুতের গতি সম্পন্ন বুরাক অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতেই অগ্রসর হচ্ছিল। কারণ দুলহা বা বর ঘোড়ায় চড়ে একটু ধীর গতিতেই অগ্রসর হয়ে থাকে।
পক্ষান্তরে মিরাজ উপলক্ষে অন্যান্য নবীগণের করণীয় কাজের সময় সুনির্দিষ্ট ছিল বিদায় তারা এখন ছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাসে আবার মুহুর্তেই পৌঁছে গেলেন বিভিন্ন আসমানে।
প্রখ্যাত শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) আশ আতুল লম আত গ্রন্থে যিয়ারাতুল কুবুর শিরোনামের অধ্যায়ের শেষে লিখেছেন- প্রতি বৃহস্পতিবার মৃত ব্যাক্তিবর্গের রূহ সমূহ নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গিয়ে তাদের ইসালে ছওয়াব এর প্রত্যাশী হয়। তাহলে যদি কোন মৃতিব্যক্তির পরিবারবর্গ বা আত্মীয়-স্বজন বিদেশে থাকে সেখানেও তার রুহ পৌঁছবে।
আমার এসব বক্তব্য দ্বিধাহীনভাবে জানা গেল যে, সমস্ত জগতের উপর নজর রাখা, মাঝে মাঝে প্রত্যেক জায়গায় পরিভ্রমণ করা, একই সময়ে কয়েক জায়গায় বিদ্যমান থাকা ইত্যাদি এমন কতগুলো গুণ বা শক্তি যা মাহাপ্রভু বান্দাদেরকে দান করেছেন।
এ বক্তব্য থেকে নিম্নোক্ত দুটি বিষয় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হয়ঃ
ক) কোন বান্দাকে প্রত্যেক জায়গায় হাযির-নাযির জ্ঞান করা শিরক নয়। শিরক হচ্ছে খোদার সত্ত্বা ও গুণাবলীতে অন্য কাউকে অংশীদার জ্ঞান করা। এখানে তা হচ্ছে না।
খ) হুযুর আলাইহিস সালামের খাদিমগণের মধ্যে প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান থাকার শক্তি নিহিত আছে তাই হুযুর আলাইহিস সালাম এর মধ্যে এ গুণটি যে সর্বাধিক পরিমাণে আছে তা বলাই বাহুল্য।
২) পথিবীতে প্রত্যেক জায়গায় দানাপানি নেই বরং বিশেষ বিশেষ স্থানে তা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো রয়েছে। পানিতো কূপ, পুকুর, নদী ইত্যাদিতে রয়েছে আর খাদ্য শস্য আছে ক্ষেতে খামারে বা ঘরবাড়ী ইত্যাদিতে। কিন্তু বায়ু ও রোদ জগতের প্রত্যেক জায়গায় রয়েছে। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের নিকট বায়ু শূন্য স্থানের অস্তিত্বই অসম্ভব। তাই স্বীকার করতে হবে যে প্রত্যেক জায়গায় বায়ু রয়েছে। কারণ প্রত্যেক বস্তুর জন্য সবসময় আলো বাতাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অনুরূপ, খোদার প্রত্যেক মাখলুকের জন্য সদা-সর্বদা হাবীবে খোদা আলাইহিস সালাম এর প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি, যা তাফসীরে রূহুল বয়ান ইত্যাদি গ্রন্থের বরাত দিয়ে প্রমাণ করেছি। সুতরাং হুযুর আলাইহিস সালাম যে সব জায়গায় বিরাজমান, তা অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হয়।
৩) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টিজগতের মূল। তিনি ইরশাদ করেছেন- وَكُلُّالْخَلْقِ مِنْ نُوْرِىْ (সমস্ত সৃষ্টি আমার নূর থেকে সৃষ্ট।) শাখা প্রশাখায় মূলের অস্তিত্ব, শব্দাবলীর বিবিধ রূপের মধ্যে শব্দ-মূলের অস্তিত্ব এবং সমস্ত সংখ্যার মধ্যে মৌলিক এক সংখ্যার অস্তিত্ব একান্ত জরুরী। এ প্রসঙ্গে জনৈক কবি খুব সুন্দর কথাই বলেছেন-
সৃষ্টি মাত্রই তার থেকে তিনি প্রত্যেক কিছুতেই বিদ্যমান। তিনি যেন অংক শাস্ত্রের মৌল সংখ্যা ১ (এক) তিনিই দুজাহানের ভিত্তি মূল। এমন কিছু নেই যা তাঁর থেকে সৃষ্ট হয়নি। -সুত্রঃ জাআল হক ১ম খন্ড-
[স্বনামধন্য কবি হুযুর আলাইহিস সালামকে সম্বোধন করে বলেছেন হে নবী! আপনি হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর অপূর্ব সৌন্দর্য রাশিতে ভূষিত, হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) এ ফুঁক দিয়ে জীবন দানের ক্ষমতা সম্পন্ন ও হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) (এর য়াদে বায়যার) একটি হাত বগলেন নিচে এনে বের করলে উজ্জ্বলরূপে ভাস্বর হওয়ার মুজিযা) অধিকারী। যে সব গুণাবলী পূর্ববর্তী নবীগণ পৃথক পৃথকভাবে লাভ করেছিলেন সব গুণাবলী আপনার মধ্যে সামগ্রিকরূপে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।]
মওলভী কাসেম সাহেব তার রচিত তাহযীরুন্নাস গ্রন্থের ৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- অন্যান্য নবীগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসালাম থেকে গ্রহণ করেই তাদের নিজ নিজ উম্মতকে ফয়েয দান করেছেন। মোট কথা অন্যান্য নবীগণের মধ্যে যেসব গুণাবলী নিহিত আছে সেগুলি হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণাবলীর ছায়া বা প্রতিফলিত রুপ। এ প্রসঙ্গে কুরআন হাদীছ ও সুপ্রসিদ্ধ আলেমগণের উক্তি থেকে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীগণও এ কথাটি স্বীকার করেন বিধায় সে কথার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ নিষ্প্রয়োজন। এখন স্বীকৃত সিদ্ধান্ত হলো, কেউ যদি পূর্ণতা জ্ঞাপক কোন গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন, তাহলে সে গুণে পুর্ণরূপে ভূষিত হয়েছেন হুযুর আলাইহিস সালাম। এ নিয়মানুযায়ী সব জায়গায় হাযির-নাযিরহওয়ার ক্ষমতা যেহেতু অনেক মাখলুককে দান করা হয়েছে, সেহেতু স্বীকার করতেই হয় যে, এ গুণও হুযুর আলাইহিস সালামকে দান করা হয়েছে।
হাযির-নাযির হওয়ার ক্ষমতা কোন কোন সৃষ্ট জীবকে দান করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে এখন আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি। আমি হাযির-নাযির শীর্ষিক আলোচনার ভূমিকায় বলেছি যে, হাযির-নাযির হওয়ার তিনটি মানে আছেঃ এক জায়গায় থেকে সমস্ত জগতকে হাতের তালুর মত দেকতে পাওয়া নিমেষেই সমগ্র জগত পরিভ্রমণ করা ও শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থানকারী কাউকে সাহায্য করা এবং পার্থিব শরীর কিংবা অনুরূপ শরীর নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যমান হওয়া। এসব গুণাবলী অনেক সৃষ্টজীবের মধ্যেও নিহিত আছে।
১) রূহুল বয়ান খাযেন; তাফসীরে কবীর ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থ সমূহ ৭ম পারার সুরা আনআম এর আয়াত حَتَّى اِذَا جَاءَ اَحَدَ كُمُالْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছেঃ
جُعِلَتِ الْاَرْضُ لملَكَ الْمَوْتِ مِثْلَ الطَّشْتِ يَتَنَاوَلُ مِنْ حَيْثُ شَاء
অর্থাৎ মলকুল মওত এর জন্য সমগ্র ভূ-খণ্ডকে এমন একটি থালার মত করে দেওয়া হয়েছে যে, তার ইচ্ছানুযায়ী সেই থালা থেকে তিনি নিতে পারেন।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ জায়গায় আরও বলা হয়েছে-
لَيْسَ عَلَى مَلَكِ الْمَوْتِ صَعُوْبَةٌ فِىْ قَبْضِ الْاَرْوَاحِ وَاِنْ كَثُرَتْ وَكَانَتْ فِىْ اَمْكِنَةٍ مُتَعَدِّدَةٍ
অর্থাৎ মলকুল মওতের রূহসমূহ কবজ করতে কোন বেগ পেতে হয় না যদিও রূহ সংখ্যায় বেশী হয় ও বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে থাকে। তাফসীরে খাযেনে সে একই আয়াতের নিচে লিখা হয়েছে-
مَامِنْ اَهْلِ بَيْتِ شَعْرٍ وَّلَامَدَرٍ اِلَّامَلَكُ الْمَوْتِ يُطِيْفُ بِهِمْ يَوْمًا مَرَّتَيْنِ
অর্থাৎ প্রতিটি তাবু বা ঘরে বসবাসকারী এমন কোন জীব নেই যার কাছে মলকুল মওত দিনে দুবার না যান।
মিশকাত শরীফের باب فضل الاذان শীর্ষক অধ্যায়ে আছেঃ যখন আযান ও তকবীর বলা হয়, তখন শয়তান ৩৬ মাইল দুরে পালিয়ে যায়; আবার যখন আযান-তকবীরের পালা শেষ হয়ে যায় সে পুনরায় উপস্থিত হয়। আগুন হতে সৃষ্ট জীবের গতির এ অবস্থা!
আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের একটি রূহ শরীর থেকে বের হয়ে জগতের এদিক সেদিক বিচরণ করে এ রূহকে বলা হয় রূহে সাইরানী (বিচরণকারী রূহ) যার প্রমাণ কুরআন পাকেও রয়েছে وَيُمْسِلُ اُخْرى আল্লাহ অপর রুহকে আবদ্ধ রাখেন। (যে মাত্র কেউ ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীরের পার্শ্বে দাড়িয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠাল, তখনই সে রূহ, যা মক্কায় কিংবা পবিত্র মদীনায় বিচরণ করছিল, তৎক্ষণাৎ শরীরে পুনঃ প্রবেশ করল, ঘুমন্ত ব্যাক্তি জেগে উঠল।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে وَهُوَ الَّذِيْ يَتَوَفَّكُمْ بِاللَّيْلِ الح আয়াতে ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
فَاِذَااِنْتَبَهَ مِنَ النَّوْمِ عَادَتِ الرُّوْحُ اِلَى جَسَدٍ بِاَسْرَعَ مِنْ لَّخْظَةٍ
অর্থাৎ মানুষ যখন ঘুম থেকে জেগে উঠে, এক মুহূর্তের চেয়েও কম সময়ে সে রূহ শরীরে ফিরে এসে যায়।
আমাদের দৃষ্টির নুর মুহূর্তেই সমস্ত জগত পরিভ্রমণ করে বিদ্যুৎ, তার, টেলিফোন ও লাউড স্পীকারের গতিশক্তির অবস্থা হচ্ছে আধা সেকেন্ডে ভূ- খন্ডের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অতিক্রম করে ফেলে। হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর গতির অবস্থা হলো, হযরত ইউসুফ (আঃ) যখন কূপের অর্ধেক অংশ থেকে নিচের দিকে পতিত হচ্ছিলেন, সে মুহুর্তেই হযরত জিব্রাইল (আঃ) সিদরাতুল মুনতাহা থেকে যাত্রা করলেন, আর নিমেষেই হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কূপের তলায় পতিত হওয়ার পূর্বেই তাঁর নিকট পৌঁছে গেলেন। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে রুহুল বয়ানে আয়াত اَنْ يَّجْعَلُوْاهُ فِىْ غَيَابّةِ الْجُبِّ এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য। হযরত ইব্রাহীম খলীল (আঃ) হযরত ঈসমাইল (আঃ) এর গলায় ছুরি চালালেন, ছুরি চলার আগেই জিব্রাইল (আঃ) সিদরা হতে দম্বা সমেত হযরত খলিলুল্লাহর (আঃ) খিদমতে হাযির হয়ে গেলেন। হযরত সুলাইমান (আঃ) এর উযীর আসিফ বিন বরখিয়া এক পলকেই রাণী বিলকিসের সিংহাসন ইয়ামন থেকে সিরিয়ায় হযরত সুলাইমান (আঃ) এর নিকট নিয়ে এলন, যার প্রমাণ কুরআন করীমেই রয়েছে।
বলা হয়েছেঃ-
اِنَّا اَتِيْكَ بِه قَبْلَ اَنْ يَّرْ تَدَّ اِلَيْكَ طَرْفُكَ
অর্থাৎ আমি আপনার চোখের পলক ফেলার আগেই সেটি নিয়ে আসছি। এ থেকে জানা গেল যে, হযরত আসিফের এ খবরও ছিল যে সিংহাসনটি কোথায় ছিল। লক্ষ্য করুন নিমিষেই তিনি ইয়মন গেলেন আর এত ভারী একটি সিংহাসন নিয়ে ফিরে এলেন। এখন প্রশ্ন হলো হযরত সুলাইমান (আঃ) এর সিংহাসন আনার এ ক্ষমতা ছিল কিনা? এ প্রসঙ্গে অত্র আলোচনার ২য় অধ্যায়ে ইনশাআল্লাহ আলোকপাত করব।
মিরাজের সময় সমস্ত নবী (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে হুযুর আলাইহিস সলাম এ পিছনে নামায আদায় করেছেন। নামাযের পর হুযুর আলাইহিস সালাম বুরাকে আরোহন পূর্বক অগ্রসর হচ্ছিলেন। বুরাকের গতির অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করুন। তার দৃষ্টি সীমার শেষ প্রান্তে তার এক পা পড়তো। অন্য দিকে নবীগণের দ্রুত গতির প্রতি লক্ষ্য করুন এখনই বায়তুল মুকাদ্দাসে তাঁরা ছিলেন মুক্তাদী, এখনই তারা বিভিন্ন আসমানে পৌঁছে গেলেন। হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, আমি অমুক আসমানে অমুক পয়গাম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। এ থেকে জানা যায় যে, বিদ্যুতের গতি সম্পন্ন বুরাক অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতেই অগ্রসর হচ্ছিল। কারণ দুলহা বা বর ঘোড়ায় চড়ে একটু ধীর গতিতেই অগ্রসর হয়ে থাকে।
পক্ষান্তরে মিরাজ উপলক্ষে অন্যান্য নবীগণের করণীয় কাজের সময় সুনির্দিষ্ট ছিল বিদায় তারা এখন ছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাসে আবার মুহুর্তেই পৌঁছে গেলেন বিভিন্ন আসমানে।
প্রখ্যাত শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) আশ আতুল লম আত গ্রন্থে যিয়ারাতুল কুবুর শিরোনামের অধ্যায়ের শেষে লিখেছেন- প্রতি বৃহস্পতিবার মৃত ব্যাক্তিবর্গের রূহ সমূহ নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গিয়ে তাদের ইসালে ছওয়াব এর প্রত্যাশী হয়। তাহলে যদি কোন মৃতিব্যক্তির পরিবারবর্গ বা আত্মীয়-স্বজন বিদেশে থাকে সেখানেও তার রুহ পৌঁছবে।
আমার এসব বক্তব্য দ্বিধাহীনভাবে জানা গেল যে, সমস্ত জগতের উপর নজর রাখা, মাঝে মাঝে প্রত্যেক জায়গায় পরিভ্রমণ করা, একই সময়ে কয়েক জায়গায় বিদ্যমান থাকা ইত্যাদি এমন কতগুলো গুণ বা শক্তি যা মাহাপ্রভু বান্দাদেরকে দান করেছেন।
এ বক্তব্য থেকে নিম্নোক্ত দুটি বিষয় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হয়ঃ
ক) কোন বান্দাকে প্রত্যেক জায়গায় হাযির-নাযির জ্ঞান করা শিরক নয়। শিরক হচ্ছে খোদার সত্ত্বা ও গুণাবলীতে অন্য কাউকে অংশীদার জ্ঞান করা। এখানে তা হচ্ছে না।
খ) হুযুর আলাইহিস সালামের খাদিমগণের মধ্যে প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান থাকার শক্তি নিহিত আছে তাই হুযুর আলাইহিস সালাম এর মধ্যে এ গুণটি যে সর্বাধিক পরিমাণে আছে তা বলাই বাহুল্য।
২) পথিবীতে প্রত্যেক জায়গায় দানাপানি নেই বরং বিশেষ বিশেষ স্থানে তা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো রয়েছে। পানিতো কূপ, পুকুর, নদী ইত্যাদিতে রয়েছে আর খাদ্য শস্য আছে ক্ষেতে খামারে বা ঘরবাড়ী ইত্যাদিতে। কিন্তু বায়ু ও রোদ জগতের প্রত্যেক জায়গায় রয়েছে। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের নিকট বায়ু শূন্য স্থানের অস্তিত্বই অসম্ভব। তাই স্বীকার করতে হবে যে প্রত্যেক জায়গায় বায়ু রয়েছে। কারণ প্রত্যেক বস্তুর জন্য সবসময় আলো বাতাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অনুরূপ, খোদার প্রত্যেক মাখলুকের জন্য সদা-সর্বদা হাবীবে খোদা আলাইহিস সালাম এর প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি, যা তাফসীরে রূহুল বয়ান ইত্যাদি গ্রন্থের বরাত দিয়ে প্রমাণ করেছি। সুতরাং হুযুর আলাইহিস সালাম যে সব জায়গায় বিরাজমান, তা অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হয়।
৩) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টিজগতের মূল। তিনি ইরশাদ করেছেন- وَكُلُّالْخَلْقِ مِنْ نُوْرِىْ (সমস্ত সৃষ্টি আমার নূর থেকে সৃষ্ট।) শাখা প্রশাখায় মূলের অস্তিত্ব, শব্দাবলীর বিবিধ রূপের মধ্যে শব্দ-মূলের অস্তিত্ব এবং সমস্ত সংখ্যার মধ্যে মৌলিক এক সংখ্যার অস্তিত্ব একান্ত জরুরী। এ প্রসঙ্গে জনৈক কবি খুব সুন্দর কথাই বলেছেন-
সৃষ্টি মাত্রই তার থেকে তিনি প্রত্যেক কিছুতেই বিদ্যমান। তিনি যেন অংক শাস্ত্রের মৌল সংখ্যা ১ (এক) তিনিই দুজাহানের ভিত্তি মূল। এমন কিছু নেই যা তাঁর থেকে সৃষ্ট হয়নি। -সুত্রঃ জাআল হক ১ম খন্ড-