১) বুখারী শরীফের بَدْءِ الْخَلْقِ শীর্ষক আলোচনায় ও মিশকাত শরীফের দ্বিতীয় খণ্ডের بَدْءِ الْخَلْقِ وَذِكْرُ الْاَنْبِيَاءِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত উমর (রাদিয়াআল্লাহু আনহু) থেকে বর্নিতঃ
قَامَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامًا فَاَخْبَرَنَا عَنْ بَدْءِ لْخَلْقِ حَتَّى دَخَلَ اَهْلُ الْجَنَّةِ مَنَازِ لَهُمْ وَ اَهْلُ النَّارِ مَنَازِ لَهُمْ حَفِظَ ذلِكَ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ
অর্থাৎঃ হুযুর আলাইহিস সালাম এক জায়গায় আমাদের সাথে অবস্থান করেছিলেন সেখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে আদি সৃষ্টির সংবাদ দিচ্ছিলেন এমন কি বেহেশতবাসী ও দোযখবাসীগণ নিজ নিজ মনযিলে বা ঠিকানায় পোঁছে যাওয়া অবধি পরিব্যাপ্ত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রদান করেন। যিনি ওসব স্মরন রাখতে পেরেছেন তিনি তো স্মরন রেখেছেন, আর যিনি স্মরণ রাখতে পারেননি তিনি ভুলে গেছেন।
এখানে হুযুর আলাইহিস সালাম দু’ধরনের ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেনঃ
১) বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা কিভাবে হলো এবং
২) এর সমাপ্তি কিভাবে হবে।
অর্থাৎ রোযে আযল (সৃষ্টির ঊষালগ্ন) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক অণু-পরমাণুর পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে বর্ননা দিয়েছেনঃ
২) মিশকাত শরীফের اَلْمُعْجِزَاتِ অধ্যায়ে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে আযর ইবনে আখতাব থেকে একই কথা বর্নিত, তবে এতে এতটুকু অতিরিক্ত আছেঃ
فَاَخْبَرْنَا بِمَاهُوْ كَائِنٌ اِلى يَوْمِ الْقِيَمَةِ فَاعْلَمْنَا اَخْفَظُنَا
(আমাদেরকে সেই সমস্ত ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেন যে গুলো কিয়ামত পর্যন্ত ঘটতে থাকবে। আমাদের মধ্যে সব চেয়ে আলিম হলেন তিনি, যিনি এ সব বিষয়াদি সর্বাধিক স্মরন রাখতে পেরেছেন।)
৩) মিশকাত শরীফের اَلْفِتنٌ শীর্ষক অধ্যায়ে বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে হযরত হুযাইফা (রাদিয়াআল্লাহু আনহু) থেকে বর্নিত হয়েছেঃ
مَاتَرَكَ شَيْأً يَكُوْنُ فِىْ مَقَامِه اِلَى يَوْمِ الْقِيمَةِ اِلَّا حَدَّثَ بِه حَفِظَهُ مَنْ حَفِطَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيْهُ
অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালাম সে জায়গায় কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব কিছুর খবর দিয়েছেন, কোন কিছুই বাদ দেননি। যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা সব স্মরন রেখেছেন, আর অনেকে ভুলেও গেছেন।
৪) মিশকাত শরীফের ‘ফযায়েলে সায়্যিদুল মুরসালীন’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘মুসলিম শরীফের’ বরাত দিয়ে হযরত সওবান (রাদিয়াআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণনা করা হয়েছেঃ-
اِنَّ اللهَ زَوى لِىَ الْاَرْضَ فَرَءَيْتُ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমার সম্মুখে গোটা পৃথিবীকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করেছেন, যে আমি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত ও পশ্চিমপ্রান্ত সমূহ স্বচক্ষে অবলোকন করেছি।
(৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবদুর রহমান ইবন আয়েশ (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ- আমি আল্লাহ তা’আলাকে সুন্দরতম আকৃতিতে দেখেছি। তিনি স্বীয় কুদরতের হাতখানা আমার বুকের উপর রাখলেন, যার শীতলতা আমি স্বীয় অন্তঃস্থলে অনুভব করেছি। ফলে, আসমান যমীনের সমস্ত বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছি।
(৬) শহরে মাওয়াহেবে লদুনিয়ায়’ (হযরত আল্লামা যুরকানী (রহতুল্লাহে আলাইহে) প্রণীত) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছেঃ-
اِنَّ اللهَ رَفَعَ لِىْ الدُّنْيَا فَاَنَا اَنْظُرُ اِلَيْهَا وَاِلى مَهُوَ كَائِنٌ فِيْهَا اِلى يَوْمِ الْقِيَمَةِ كَاَنَّمَا اَنْظُرُ اِلَى كَفِّىْ هذَا
অর্থাৎঃ আল্লাহ তা’আলা আমার সামনে সারা দুনিয়াকে তুলে ধরেছেন। তখন আমি এ দুনিয়াকে এবং এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা’কিছু হবে এমন ভাবে দেখতে পেয়েছি, যেভাবে আমি আমার নিজ হাতকে দেখতে পাচ্ছি।
(৭) মিশকাত শরীফের মাসাজিদ অধ্যয়ে তিরমিযী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছেঃ فَتَجَلَّى لِىْ كُلُّ شَيْئٍ وَعَرَفْتُ (তখন প্রত্যেক কিছু আমার কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং আমি এগুলো চিনতে পেরেছি।)
(৮) মসনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলে হযরত আবুযর গিফারী (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ-
لَقدْ تَرَكْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ وَما يُحَرِّكُ طَائِرٌ جَنَاحَيْهِ اِلَّا ذَكَرَلَنَا مِنْهُ عِلْمًا
(হুযুর আলাইহিস সালাম আমাদেরকে এমনভাবে অবহিত করেছেন যে, একটা পাখীর পালক নড়ার কথা পর্যন্ত তার বর্ণনা থেকে বাদ পড়েনি।
(৯) মিশকাত শরীফের ‘ফিতনা’ নামক অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হযরত হুযাইফা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ- (হুযুর আলাইহিস সালাম পৃথিবীর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য কোন ফিতনা পরিচালনাকারীর কথা বাদ দেননি যাদের সংখ্যা তিনশত কিংবা ততোধিক হবে এমন কি তাদের নাম তাদের বাপের নাম ও গোত্রের নামসহ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন।)
১০) মিশকাত শরফের ذِكْرُ الْاَنْبِيَاءِ শীর্ষক অধ্যয়ে বুখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত আবু হুরাইরা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিতঃ-
حُفِّفَ عَلى دَاؤُدَ الْقُرْاَنُ فَكانَ يَأمُرُ دَوَاَبَّة فَتُسْرَجُ فَيَقْرَءُ الْقُرْانَ قَبْلَ اَنْ تُسْرَجَ
(হযরত দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর জন্য কুরআনকে (যবুর গ্রন্থ) এমনভাবে সহজ করে দেয়া হয়েছিল যে, তিনি নিজ ঘোড়াদেরকে যীন দ্বারা সজ্জিত করার হুকুম দিতেন আর ইত্যবসরে তিনি যীন পরানোর আগেই যবুর শরীফ পড়ে ফেলতেন।)
এ হাদীসটি এখানে এ জন্যই বর্ণনা করা হলো যে যদি হুযুর আলাইহিস সালাম একই ভাষণে সৃষ্টি আদ্যোপান্ত যাবতীয় ঘটনাবলী বর্ণনা করে থাকেন তাহলে এও তার মুজিযা ছিল, যেমন হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এক মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ যবুর শরীফ পড়ে ফেলতেন।
১১) মিশকাত শরীফের مَنَاقِبِ اَهْلُ الْبَيْتِ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছেঃ-
تَلِدْ فَاطِمَةُ اِنْ شَاءَ اللهُ غُلَامًا يَكُوْنُ فِىْ حَجْرِكَ
অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালাম হযরত উম্মুল ফযল (রাদিআল্লাহু আনহু) এর নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, হযরত ফাতিমা যুহরা (রাদিআল্লাহু আনহু) এর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে, সে তোমারই (হযরত উম্মুল ফযল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) কোলে লালিত পালিত হবে।
১২) বুখারী শরীফে اِثْبَاتِ عَذَابِ الْقَبْرِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রহমতুল্লাহে আলাইহে) থেকে বর্ণিত আছেঃ- (হুযুর আলাইহিস সালাম একদা দুটো কবরের পার্শ্বে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কবর দুটোতে আযাব হচ্ছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এ দুজনের আযাব হচ্ছে কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধের জন্য নয়। তাদের মধ্যে একজন প্রশ্রাবের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতো না। অপরজন চোগলখুরী করে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করত। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) খেজুরের একটি কাঁচা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগে ভাগ করলেন ও অংশ দু’টো উভয় কবরে একটি করে পুঁতে দিলেন এবং ইরশাদ করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাল দু’টো শুকিয়ে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি লাঘব হবে।
(১৩) বুখারী শরীফের- كِتَابُ الْاِعْتِصَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ এ ও খাযেনে لَا تَسْئَلُوْا عَنِ الْاَشْيَاءِ اِنْ تُبْدَ لَكُمْ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে- (একদিন হুযুর আলাহিস সালাম মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন। অতপর কিয়ামতের উল্লেখপূর্বক এর আগে যে সমস্ত ভয়ানক ঘটনাবলী ঘটবে, সে সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন। এরপর তিনি রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘যার যা খুশি জিজ্ঞাসা করতে পার।’ খোদার শপথ, এ জায়গা অর্থাৎ এ মিম্বরে আমি যতক্ষণ দন্ডয়মান আছি, ততক্ষণ তোমরা যা জিজ্ঞাসা কর না কেন, আমি অবশ্যই উত্তর দেব।’ জনৈক ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আরয করলেন, ‘পরকালে আমার ঠিকানা কোথায়?’ ইরশাদ ফরমালেন জাহান্নামের মধ্যে।
আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা’ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমার বাপ কে’? ইরশাদ করেন, হুযাফা।’ এর পর তিনি (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বার বার ইরশাদ ফরমান, জিজ্ঞাসা করো, জিজ্ঞাসা করো।
মনে রাখা দরকার যে কারো ‘জাহান্নামী’ বা জান্নাতী হওয়া সম্পর্কে জানা পঞ্চ জ্ঞানের (علوم خمسه) অন্তর্ভূক্ত। সৌভাগ্যবান কিংবা হতভাগা হওয়ার বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানও পঞ্চ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ কে কার ছেলে এ সম্পর্কিত জ্ঞানও উক্ত’ পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞানের আওতাভূক্ত। অধিকন্তু এটা এমন একটি বিষয়, যা শুধু ব্যাক্তি বিশেষের মা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। তাঁর (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এহেন দৃষ্টির জন্য সবকিছু্ই উৎসর্গকৃত, যে দৃষ্টিতে আলো-অন্ধকার, দুনিয়া-আখিরাত সবকিছুই দৃষ্টিগোচর হয়।
১৪) মিশকাত শরীফের مناقب على অধ্যায়ে বর্ণিত আছেঃ-
قَلَ يَوْمَ خَيْبَرَ لَاُ عْطِيَنُّ هذِهِ الرَّايَةَ غَذًا رَجُلًا يَقْتَحُ اللهُ عَلَى يَدَيْهِ يُحِبُّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ
(হুযুর আলাইহিস সালাম খায়বরের যুদ্ধের দিন ইরশাদ ফরমানঃ ‘আমি আগামী দিন এ পতাকা এমন ব্যাক্তিকে অর্পণ করবো, যার হাতে আল্লাহ তা’আলা ‘খায়বরের বিজয় নির্ধারণ করেছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে ভালবাসেন।)
১৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবুযর গিফারী (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে।
عُر ضَتْ عَلَىَّ اَعْمَالُ اُمَّتِىْ حَسَنُهَا وَسَيِّئُهَا فَوَجَدْت فِىْ مَحَاسِنِ اَعْمَالِها الْاَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيْقِ
(আমার সামনে আমার উম্মতের ভালমন্দ সমূহ পেশ করা হয়েছে। আমি তাদের নেক আমল সমূহের মধ্যে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সমূহ অপসারনের মত পূণ্য কাজও লক্ষ্য করেছি।
১৬) মুসলিম শরীফের كتاب الجهاد ২য় খন্ডের ‘বদরের যুদ্ধ’ শীর্ষক অধ্যয়ে হযরত আনাস (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু)থেকে বর্ণিত আছে- (হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমান এটা অমুক ব্যক্তির নিহত হয়ে পতিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থান এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) তার পবিত্র হস্ত মোবারক যমীনের উপর এদিক সেদিক সঞ্চালন করছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, নিহত ব্যাক্তিদের মধ্যে কেউ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর হাতের নির্দেশিত স্থানের কিঞ্চিত বাহিরেও পতিত হয়নি।)
লক্ষণীয় যে, কে কোন জায়গায় মারা যাবে এ বিষয়ে পঞ্চ জ্ঞানের علوم خمسة অন্তর্ভুক্ত, যার সংবাদ বদর যুদ্ধের একদিন আগেই হুযুর আলাইহিস সালাম দিচ্ছিলেন।
(১৭) মিশকাত শরীফের ‘মুজিযাত’ অধ্যায়ে হযরত আবু হোরায়রা (রাদিয়াআল্লাহ আনহু) থেকে বর্ণিত আছে-
فَقَالَ رَجُلُ تَاللهِ اِنْ رَئَيْتُ كَالْيَوْمِ ذِئْبٌ يَتَكَلَّمُ فَقَالَ الذِّئْبُ اَعْجَبُ مِنْ هذَا رَجُلٌ فِى النَّخْلَاتِ بَيْنَالْحَرَّتَيْنِ يُخْبِرُ كُمْ بِمَا مَضى وَمَاهُوَ كَائْنٌ بَعْدَكُمْ
জনৈক শিকারী আশ্চর্য হয়ে বললো নেকড়ে বাঘকে আজ যেরুপ কথা বলতে দেখলাম সেরুপ ইতিপূর্বে আর কখনো দেখিনি। তখন নেকড়ে বাঘ বলে উঠলো এর চেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো-ঐ দুই উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যবর্তী মরুদ্যানে (মদিনায়) একজন সম্মানিত ব্যাক্তি (হুজুর আলাইহিস সালাম) আছেন, যিনি তোমাদের নিকট বিগত ও অনাগত ভবিষ্যতের বিষয় সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন করেন।
(১৮) তাফসীরে খাযেনের ৪র্থ পারায় مَاكَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلى مَااَنْتُمْ عَلَيْهِ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
(হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমানঃ আমার কাছে আমার উম্মতকে তাদের নিজ নিজ মাটির আকৃতিতে পেশ করা হয়েছে, যেমনভাবে আদম (আলাইহিস সালামের)কাছে পেশ করা হয়েছিল। আমাকে বলে দেয়া হয়েছে কে আমার উপর ঈমান আনবে, আর কে আমাকে অস্বীকার করবে। যখন এ খবর মুনাফিকদের নিকট পৌছল তখন তারা হেসে বলতে লাগলো হুযুর আলাইহিস সালাম ওসব লোকদের জন্মের আগেই তাদের মুমিন ও কাফের হওয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন অথচ আমরা তার সাথেই আছি কিন্ত আমাদেরকে চিনতে পারেন নি। এ খবর যখন হুযুর আলাইহিস সালামের নিকট পৌছলো তখন তিনি মিম্বরে উপর দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ইরশাদ ফরমানঃ এসব লোকদের কি যে হলো, আমার জ্ঞান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন বিষয় তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করো আমি অবশ্যই বলে দিব)।
এ হাদিস দ্বারা দুটি বিষয় সম্পর্কে জানা গেল। এক, হুযুর আলাইহিস সালাম এর জ্ঞান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। দুই, কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে হুযুর আলাইহিস সালাম অবগত।
(১৯) মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুল ফিতান’ যুদ্ধ বিগ্রহের শীর্ষক অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে মসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ
اِنِّىْ لَاَعْرِفُ اَسْمَاءَ هُمْوَاَسْمَاء اَبَاءِهِمْ وَاَلْوَانَ خَيُوْلِهِمْ خَيْرُ فَوَارِسِ اَوْمِنْ خَيْرِ فَوَارِسَ عَلى ظَهْرِالْاَرَضِ
অর্থাৎঃ তাদের নাম, (দাজ্জালের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণকারীগণের) তাঁদের বাপ-দাদাদের নাম ও তাঁদের ঘোড়া সমূহের বর্ণ পর্যন্ত আমার জানা আছে। তারাই হবেন ভূ-পৃষ্টের সর্বো উৎকৃষ্ট ঘোড়সওয়ার।
(২০) মিশকাত শরীফের مناقب ابي بكر وعمر অধ্যয়ে বর্ণিত আছেঃ হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদিআল্লাহু আনহু) হুযুর আলাইহিস সালামের নিকট জানতে চাইলেন, এমন কেউ আছেন কিনা যা’র নেকী সমূহ তারকারাজির সমসংখ্যক হবে? হুযুর আলাইহিস সালাম উত্তরে ইরশাদ ফরমান, হ্যাঁ, এবং তিনি হলেন হযরত উমর (রাদিআল্লাহু আনহু)।
এ থেকে বোঝা গেল যে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের দৃশ্যমান ও গোপনীয় যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কে হুযুর আলাইহিস সালাম পূর্ণরূপে অবগত আছেন। আসমানের সমস্ত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নক্ষত্র সমূহেরও বিস্তারিত জ্ঞান তাঁর (হুযুর আলাইহিস সালাম) এর রয়েছে; অথচ নক্ষত্র সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকগণ তাদের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যেও এখনও পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি।
হুযুর আলাইহিস সালাম এ দু’বিষয় (আমল ও নক্ষত্র সম্বন্ধে সম্যকরূপে অবগত বিধায় বলে ছিলেন যে, হযরত উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) এর নেকসমূহ নক্ষত্র রাজির সংখ্যার সমান। দু’টো বস্তুর পরিমাণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে সমান বা কম বেশী হওয়া সম্পর্কে তিনিই বলতে পারেন, যিনি উভয়টির জ্ঞান রাখেন। উভয় বস্তুর সংখ্যা বা পরিমাণ সম্বন্ধেও সম্যকরূপে অবগত হন।
এ গুলো ছাড়াও আরও অনেক হাদীছ উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এ পরিচ্ছেদকে সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এতটুকু যথাযথ মনে কারা হয়েছে। এ হাদীস সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, সমস্ত জগত হুযুর আলাইহিস সালামের কাছে নিজ হাতের তালুর মত। লক্ষণীয় যে عالم (আলম) বলতে আল্লাহ ব্যাতীত বাকী সবকিছুকে বোঝায়। সুতরাং আলমে মালায়িকা (স্তুল জগত, সূক্ষ্ম জগত ও সৃক্ষ্ণাতি সূক্ষ্ম জগৎ সমূহ) আরশ ও ফরশ মোট কথা প্রত্যেক কিছুর উপর হুযুর আলাইহিস সালামের দৃষ্টি রয়েছে। আলমের অন্তর্ভুক্ত লওহে মাহফুজও, যেখানে সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ আছে।
দ্বিতীয়তঃ এও বোঝা গেল যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কেও জ্ঞাত।
তৃতীয়তঃ ইহাও বোঝা গেল যে, রাতের অন্ধকারে নির্জনে নিভৃতে যেসব কাজ সম্পন্ন করা হয়, উহাও মুহাম্মদ মুস্তাফা আলাইহিস সালামের দৃষ্টি থেকে লুকায়িত নয়। যেমন আবদুল্লাহের বাপ যে হুযাইফা সে সম্পর্কেও তিনি বলে দিয়েছেন।
চতুর্থতঃ এও বোঝা গেল যে, কে, কখন, কোথায় মারা যাবে, কোন অবস্থায় মারা যাবে, কাফির কি মুমিন হবে, নারীর গর্ভে কি আছে- এ সমস্ত কোন বিষয়ই হুযুর আলাইহিস সালাম থেকে লুকায়িত নয়। মোট কথা বিশ্বের অণু-পরমাণু বিন্দু বিসর্গ সম্পর্কেও হুযুর আলাইহিস সালামের সম্যক জ্ঞান রয়েছে। -সূত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
قَامَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامًا فَاَخْبَرَنَا عَنْ بَدْءِ لْخَلْقِ حَتَّى دَخَلَ اَهْلُ الْجَنَّةِ مَنَازِ لَهُمْ وَ اَهْلُ النَّارِ مَنَازِ لَهُمْ حَفِظَ ذلِكَ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ
অর্থাৎঃ হুযুর আলাইহিস সালাম এক জায়গায় আমাদের সাথে অবস্থান করেছিলেন সেখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে আদি সৃষ্টির সংবাদ দিচ্ছিলেন এমন কি বেহেশতবাসী ও দোযখবাসীগণ নিজ নিজ মনযিলে বা ঠিকানায় পোঁছে যাওয়া অবধি পরিব্যাপ্ত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রদান করেন। যিনি ওসব স্মরন রাখতে পেরেছেন তিনি তো স্মরন রেখেছেন, আর যিনি স্মরণ রাখতে পারেননি তিনি ভুলে গেছেন।
এখানে হুযুর আলাইহিস সালাম দু’ধরনের ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেনঃ
১) বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা কিভাবে হলো এবং
২) এর সমাপ্তি কিভাবে হবে।
অর্থাৎ রোযে আযল (সৃষ্টির ঊষালগ্ন) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক অণু-পরমাণুর পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে বর্ননা দিয়েছেনঃ
২) মিশকাত শরীফের اَلْمُعْجِزَاتِ অধ্যায়ে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে আযর ইবনে আখতাব থেকে একই কথা বর্নিত, তবে এতে এতটুকু অতিরিক্ত আছেঃ
فَاَخْبَرْنَا بِمَاهُوْ كَائِنٌ اِلى يَوْمِ الْقِيَمَةِ فَاعْلَمْنَا اَخْفَظُنَا
(আমাদেরকে সেই সমস্ত ঘটনাবলীর খবর দিয়েছেন যে গুলো কিয়ামত পর্যন্ত ঘটতে থাকবে। আমাদের মধ্যে সব চেয়ে আলিম হলেন তিনি, যিনি এ সব বিষয়াদি সর্বাধিক স্মরন রাখতে পেরেছেন।)
৩) মিশকাত শরীফের اَلْفِتنٌ শীর্ষক অধ্যায়ে বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাত দিয়ে হযরত হুযাইফা (রাদিয়াআল্লাহু আনহু) থেকে বর্নিত হয়েছেঃ
مَاتَرَكَ شَيْأً يَكُوْنُ فِىْ مَقَامِه اِلَى يَوْمِ الْقِيمَةِ اِلَّا حَدَّثَ بِه حَفِظَهُ مَنْ حَفِطَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيْهُ
অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালাম সে জায়গায় কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব কিছুর খবর দিয়েছেন, কোন কিছুই বাদ দেননি। যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা সব স্মরন রেখেছেন, আর অনেকে ভুলেও গেছেন।
৪) মিশকাত শরীফের ‘ফযায়েলে সায়্যিদুল মুরসালীন’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘মুসলিম শরীফের’ বরাত দিয়ে হযরত সওবান (রাদিয়াআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণনা করা হয়েছেঃ-
اِنَّ اللهَ زَوى لِىَ الْاَرْضَ فَرَءَيْتُ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমার সম্মুখে গোটা পৃথিবীকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করেছেন, যে আমি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত ও পশ্চিমপ্রান্ত সমূহ স্বচক্ষে অবলোকন করেছি।
(৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবদুর রহমান ইবন আয়েশ (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ- আমি আল্লাহ তা’আলাকে সুন্দরতম আকৃতিতে দেখেছি। তিনি স্বীয় কুদরতের হাতখানা আমার বুকের উপর রাখলেন, যার শীতলতা আমি স্বীয় অন্তঃস্থলে অনুভব করেছি। ফলে, আসমান যমীনের সমস্ত বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছি।
(৬) শহরে মাওয়াহেবে লদুনিয়ায়’ (হযরত আল্লামা যুরকানী (রহতুল্লাহে আলাইহে) প্রণীত) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছেঃ-
اِنَّ اللهَ رَفَعَ لِىْ الدُّنْيَا فَاَنَا اَنْظُرُ اِلَيْهَا وَاِلى مَهُوَ كَائِنٌ فِيْهَا اِلى يَوْمِ الْقِيَمَةِ كَاَنَّمَا اَنْظُرُ اِلَى كَفِّىْ هذَا
অর্থাৎঃ আল্লাহ তা’আলা আমার সামনে সারা দুনিয়াকে তুলে ধরেছেন। তখন আমি এ দুনিয়াকে এবং এতে কিয়ামত পর্যন্ত যা’কিছু হবে এমন ভাবে দেখতে পেয়েছি, যেভাবে আমি আমার নিজ হাতকে দেখতে পাচ্ছি।
(৭) মিশকাত শরীফের মাসাজিদ অধ্যয়ে তিরমিযী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণিত আছেঃ فَتَجَلَّى لِىْ كُلُّ شَيْئٍ وَعَرَفْتُ (তখন প্রত্যেক কিছু আমার কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং আমি এগুলো চিনতে পেরেছি।)
(৮) মসনদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলে হযরত আবুযর গিফারী (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ-
لَقدْ تَرَكْنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ وَما يُحَرِّكُ طَائِرٌ جَنَاحَيْهِ اِلَّا ذَكَرَلَنَا مِنْهُ عِلْمًا
(হুযুর আলাইহিস সালাম আমাদেরকে এমনভাবে অবহিত করেছেন যে, একটা পাখীর পালক নড়ার কথা পর্যন্ত তার বর্ণনা থেকে বাদ পড়েনি।
(৯) মিশকাত শরীফের ‘ফিতনা’ নামক অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হযরত হুযাইফা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ- (হুযুর আলাইহিস সালাম পৃথিবীর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য কোন ফিতনা পরিচালনাকারীর কথা বাদ দেননি যাদের সংখ্যা তিনশত কিংবা ততোধিক হবে এমন কি তাদের নাম তাদের বাপের নাম ও গোত্রের নামসহ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন।)
১০) মিশকাত শরফের ذِكْرُ الْاَنْبِيَاءِ শীর্ষক অধ্যয়ে বুখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত আবু হুরাইরা (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিতঃ-
حُفِّفَ عَلى دَاؤُدَ الْقُرْاَنُ فَكانَ يَأمُرُ دَوَاَبَّة فَتُسْرَجُ فَيَقْرَءُ الْقُرْانَ قَبْلَ اَنْ تُسْرَجَ
(হযরত দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর জন্য কুরআনকে (যবুর গ্রন্থ) এমনভাবে সহজ করে দেয়া হয়েছিল যে, তিনি নিজ ঘোড়াদেরকে যীন দ্বারা সজ্জিত করার হুকুম দিতেন আর ইত্যবসরে তিনি যীন পরানোর আগেই যবুর শরীফ পড়ে ফেলতেন।)
এ হাদীসটি এখানে এ জন্যই বর্ণনা করা হলো যে যদি হুযুর আলাইহিস সালাম একই ভাষণে সৃষ্টি আদ্যোপান্ত যাবতীয় ঘটনাবলী বর্ণনা করে থাকেন তাহলে এও তার মুজিযা ছিল, যেমন হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এক মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ যবুর শরীফ পড়ে ফেলতেন।
১১) মিশকাত শরীফের مَنَاقِبِ اَهْلُ الْبَيْتِ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছেঃ-
تَلِدْ فَاطِمَةُ اِنْ شَاءَ اللهُ غُلَامًا يَكُوْنُ فِىْ حَجْرِكَ
অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালাম হযরত উম্মুল ফযল (রাদিআল্লাহু আনহু) এর নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, হযরত ফাতিমা যুহরা (রাদিআল্লাহু আনহু) এর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে, সে তোমারই (হযরত উম্মুল ফযল (রহমতুল্লাহে আলাইহে) কোলে লালিত পালিত হবে।
১২) বুখারী শরীফে اِثْبَاتِ عَذَابِ الْقَبْرِ শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রহমতুল্লাহে আলাইহে) থেকে বর্ণিত আছেঃ- (হুযুর আলাইহিস সালাম একদা দুটো কবরের পার্শ্বে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কবর দুটোতে আযাব হচ্ছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এ দুজনের আযাব হচ্ছে কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধের জন্য নয়। তাদের মধ্যে একজন প্রশ্রাবের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতো না। অপরজন চোগলখুরী করে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করত। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) খেজুরের একটি কাঁচা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগে ভাগ করলেন ও অংশ দু’টো উভয় কবরে একটি করে পুঁতে দিলেন এবং ইরশাদ করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাল দু’টো শুকিয়ে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি লাঘব হবে।
(১৩) বুখারী শরীফের- كِتَابُ الْاِعْتِصَامِ بِالْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ এ ও খাযেনে لَا تَسْئَلُوْا عَنِ الْاَشْيَاءِ اِنْ تُبْدَ لَكُمْ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে- (একদিন হুযুর আলাহিস সালাম মিম্বরের উপর দাঁড়ালেন। অতপর কিয়ামতের উল্লেখপূর্বক এর আগে যে সমস্ত ভয়ানক ঘটনাবলী ঘটবে, সে সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন। এরপর তিনি রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘যার যা খুশি জিজ্ঞাসা করতে পার।’ খোদার শপথ, এ জায়গা অর্থাৎ এ মিম্বরে আমি যতক্ষণ দন্ডয়মান আছি, ততক্ষণ তোমরা যা জিজ্ঞাসা কর না কেন, আমি অবশ্যই উত্তর দেব।’ জনৈক ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আরয করলেন, ‘পরকালে আমার ঠিকানা কোথায়?’ ইরশাদ ফরমালেন জাহান্নামের মধ্যে।
আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা’ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমার বাপ কে’? ইরশাদ করেন, হুযাফা।’ এর পর তিনি (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বার বার ইরশাদ ফরমান, জিজ্ঞাসা করো, জিজ্ঞাসা করো।
মনে রাখা দরকার যে কারো ‘জাহান্নামী’ বা জান্নাতী হওয়া সম্পর্কে জানা পঞ্চ জ্ঞানের (علوم خمسه) অন্তর্ভূক্ত। সৌভাগ্যবান কিংবা হতভাগা হওয়ার বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানও পঞ্চ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ কে কার ছেলে এ সম্পর্কিত জ্ঞানও উক্ত’ পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞানের আওতাভূক্ত। অধিকন্তু এটা এমন একটি বিষয়, যা শুধু ব্যাক্তি বিশেষের মা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। তাঁর (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এহেন দৃষ্টির জন্য সবকিছু্ই উৎসর্গকৃত, যে দৃষ্টিতে আলো-অন্ধকার, দুনিয়া-আখিরাত সবকিছুই দৃষ্টিগোচর হয়।
১৪) মিশকাত শরীফের مناقب على অধ্যায়ে বর্ণিত আছেঃ-
قَلَ يَوْمَ خَيْبَرَ لَاُ عْطِيَنُّ هذِهِ الرَّايَةَ غَذًا رَجُلًا يَقْتَحُ اللهُ عَلَى يَدَيْهِ يُحِبُّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ
(হুযুর আলাইহিস সালাম খায়বরের যুদ্ধের দিন ইরশাদ ফরমানঃ ‘আমি আগামী দিন এ পতাকা এমন ব্যাক্তিকে অর্পণ করবো, যার হাতে আল্লাহ তা’আলা ‘খায়বরের বিজয় নির্ধারণ করেছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে ভালবাসেন।)
১৫) মিশকাত শরীফের ‘মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত আবুযর গিফারী (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে।
عُر ضَتْ عَلَىَّ اَعْمَالُ اُمَّتِىْ حَسَنُهَا وَسَيِّئُهَا فَوَجَدْت فِىْ مَحَاسِنِ اَعْمَالِها الْاَذَى يُمَاطُ عَنِ الطَّرِيْقِ
(আমার সামনে আমার উম্মতের ভালমন্দ সমূহ পেশ করা হয়েছে। আমি তাদের নেক আমল সমূহের মধ্যে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সমূহ অপসারনের মত পূণ্য কাজও লক্ষ্য করেছি।
১৬) মুসলিম শরীফের كتاب الجهاد ২য় খন্ডের ‘বদরের যুদ্ধ’ শীর্ষক অধ্যয়ে হযরত আনাস (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু)থেকে বর্ণিত আছে- (হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমান এটা অমুক ব্যক্তির নিহত হয়ে পতিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থান এবং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম) তার পবিত্র হস্ত মোবারক যমীনের উপর এদিক সেদিক সঞ্চালন করছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, নিহত ব্যাক্তিদের মধ্যে কেউ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর হাতের নির্দেশিত স্থানের কিঞ্চিত বাহিরেও পতিত হয়নি।)
লক্ষণীয় যে, কে কোন জায়গায় মারা যাবে এ বিষয়ে পঞ্চ জ্ঞানের علوم خمسة অন্তর্ভুক্ত, যার সংবাদ বদর যুদ্ধের একদিন আগেই হুযুর আলাইহিস সালাম দিচ্ছিলেন।
(১৭) মিশকাত শরীফের ‘মুজিযাত’ অধ্যায়ে হযরত আবু হোরায়রা (রাদিয়াআল্লাহ আনহু) থেকে বর্ণিত আছে-
فَقَالَ رَجُلُ تَاللهِ اِنْ رَئَيْتُ كَالْيَوْمِ ذِئْبٌ يَتَكَلَّمُ فَقَالَ الذِّئْبُ اَعْجَبُ مِنْ هذَا رَجُلٌ فِى النَّخْلَاتِ بَيْنَالْحَرَّتَيْنِ يُخْبِرُ كُمْ بِمَا مَضى وَمَاهُوَ كَائْنٌ بَعْدَكُمْ
জনৈক শিকারী আশ্চর্য হয়ে বললো নেকড়ে বাঘকে আজ যেরুপ কথা বলতে দেখলাম সেরুপ ইতিপূর্বে আর কখনো দেখিনি। তখন নেকড়ে বাঘ বলে উঠলো এর চেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো-ঐ দুই উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যবর্তী মরুদ্যানে (মদিনায়) একজন সম্মানিত ব্যাক্তি (হুজুর আলাইহিস সালাম) আছেন, যিনি তোমাদের নিকট বিগত ও অনাগত ভবিষ্যতের বিষয় সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন করেন।
(১৮) তাফসীরে খাযেনের ৪র্থ পারায় مَاكَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلى مَااَنْتُمْ عَلَيْهِ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
(হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ ফরমানঃ আমার কাছে আমার উম্মতকে তাদের নিজ নিজ মাটির আকৃতিতে পেশ করা হয়েছে, যেমনভাবে আদম (আলাইহিস সালামের)কাছে পেশ করা হয়েছিল। আমাকে বলে দেয়া হয়েছে কে আমার উপর ঈমান আনবে, আর কে আমাকে অস্বীকার করবে। যখন এ খবর মুনাফিকদের নিকট পৌছল তখন তারা হেসে বলতে লাগলো হুযুর আলাইহিস সালাম ওসব লোকদের জন্মের আগেই তাদের মুমিন ও কাফের হওয়া সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছেন অথচ আমরা তার সাথেই আছি কিন্ত আমাদেরকে চিনতে পারেন নি। এ খবর যখন হুযুর আলাইহিস সালামের নিকট পৌছলো তখন তিনি মিম্বরে উপর দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ইরশাদ ফরমানঃ এসব লোকদের কি যে হলো, আমার জ্ঞান নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন বিষয় তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করো আমি অবশ্যই বলে দিব)।
এ হাদিস দ্বারা দুটি বিষয় সম্পর্কে জানা গেল। এক, হুযুর আলাইহিস সালাম এর জ্ঞান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। দুই, কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে হুযুর আলাইহিস সালাম অবগত।
(১৯) মিশকাত শরীফের ‘কিতাবুল ফিতান’ যুদ্ধ বিগ্রহের শীর্ষক অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে মুসলিম শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে মসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছেঃ
اِنِّىْ لَاَعْرِفُ اَسْمَاءَ هُمْوَاَسْمَاء اَبَاءِهِمْ وَاَلْوَانَ خَيُوْلِهِمْ خَيْرُ فَوَارِسِ اَوْمِنْ خَيْرِ فَوَارِسَ عَلى ظَهْرِالْاَرَضِ
অর্থাৎঃ তাদের নাম, (দাজ্জালের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণকারীগণের) তাঁদের বাপ-দাদাদের নাম ও তাঁদের ঘোড়া সমূহের বর্ণ পর্যন্ত আমার জানা আছে। তারাই হবেন ভূ-পৃষ্টের সর্বো উৎকৃষ্ট ঘোড়সওয়ার।
(২০) মিশকাত শরীফের مناقب ابي بكر وعمر অধ্যয়ে বর্ণিত আছেঃ হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদিআল্লাহু আনহু) হুযুর আলাইহিস সালামের নিকট জানতে চাইলেন, এমন কেউ আছেন কিনা যা’র নেকী সমূহ তারকারাজির সমসংখ্যক হবে? হুযুর আলাইহিস সালাম উত্তরে ইরশাদ ফরমান, হ্যাঁ, এবং তিনি হলেন হযরত উমর (রাদিআল্লাহু আনহু)।
এ থেকে বোঝা গেল যে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের দৃশ্যমান ও গোপনীয় যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কে হুযুর আলাইহিস সালাম পূর্ণরূপে অবগত আছেন। আসমানের সমস্ত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নক্ষত্র সমূহেরও বিস্তারিত জ্ঞান তাঁর (হুযুর আলাইহিস সালাম) এর রয়েছে; অথচ নক্ষত্র সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকগণ তাদের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যেও এখনও পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি।
হুযুর আলাইহিস সালাম এ দু’বিষয় (আমল ও নক্ষত্র সম্বন্ধে সম্যকরূপে অবগত বিধায় বলে ছিলেন যে, হযরত উমর (রাদিআল্লাহু আনহু) এর নেকসমূহ নক্ষত্র রাজির সংখ্যার সমান। দু’টো বস্তুর পরিমাণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে সমান বা কম বেশী হওয়া সম্পর্কে তিনিই বলতে পারেন, যিনি উভয়টির জ্ঞান রাখেন। উভয় বস্তুর সংখ্যা বা পরিমাণ সম্বন্ধেও সম্যকরূপে অবগত হন।
এ গুলো ছাড়াও আরও অনেক হাদীছ উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এ পরিচ্ছেদকে সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে এতটুকু যথাযথ মনে কারা হয়েছে। এ হাদীস সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, সমস্ত জগত হুযুর আলাইহিস সালামের কাছে নিজ হাতের তালুর মত। লক্ষণীয় যে عالم (আলম) বলতে আল্লাহ ব্যাতীত বাকী সবকিছুকে বোঝায়। সুতরাং আলমে মালায়িকা (স্তুল জগত, সূক্ষ্ম জগত ও সৃক্ষ্ণাতি সূক্ষ্ম জগৎ সমূহ) আরশ ও ফরশ মোট কথা প্রত্যেক কিছুর উপর হুযুর আলাইহিস সালামের দৃষ্টি রয়েছে। আলমের অন্তর্ভুক্ত লওহে মাহফুজও, যেখানে সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ আছে।
দ্বিতীয়তঃ এও বোঝা গেল যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাবলী সম্পর্কেও জ্ঞাত।
তৃতীয়তঃ ইহাও বোঝা গেল যে, রাতের অন্ধকারে নির্জনে নিভৃতে যেসব কাজ সম্পন্ন করা হয়, উহাও মুহাম্মদ মুস্তাফা আলাইহিস সালামের দৃষ্টি থেকে লুকায়িত নয়। যেমন আবদুল্লাহের বাপ যে হুযাইফা সে সম্পর্কেও তিনি বলে দিয়েছেন।
চতুর্থতঃ এও বোঝা গেল যে, কে, কখন, কোথায় মারা যাবে, কোন অবস্থায় মারা যাবে, কাফির কি মুমিন হবে, নারীর গর্ভে কি আছে- এ সমস্ত কোন বিষয়ই হুযুর আলাইহিস সালাম থেকে লুকায়িত নয়। মোট কথা বিশ্বের অণু-পরমাণু বিন্দু বিসর্গ সম্পর্কেও হুযুর আলাইহিস সালামের সম্যক জ্ঞান রয়েছে। -সূত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-